ছোটোগল্প

ঈশানকোণ একটি সাহিত্যের ওয়েবজিন বইমেলা সংখ্যা ফেব্রুয়ারি ২০১৭ ইং 

[ঈশানকোণ নতুন সংখ্যা দেখার জন্যে এখানে ক্লিক করুন]

[অনুবাদ গল্পঃ মূল মণিপুরি থেকে অনুবাদ করেছেন সদানন্দ সিংহ] 

জল
য়ুমলেম্বম ইবোমচা

কতোকাল ধরে তৃষ্ণার্ত আমি। জল কোথায় পাই ? এতোবড় শহরে ভেতরে আমি কি জল পাবো না ? কি যে করি!
মাথার ওপর সূর্য জ্বলছে। সারা শহর জুড়ে আগুনের হল্কা। বৃহৎ উচ্চ অট্টালিকার ওপর থেকে নেমে আসা আলোতে চোখ ধাঁধিয়ে যায়। এতো বড় রাস্তায় কিছুক্ষণের জন্যও পা রাখার জায়গা নেই! অজস্র গাড়ি হুস্‌ হুস্‌ করে চলে যাচ্ছে। এতো জোরে হাঁটছি আমি, তবু মনে হয় আমি যেন এগোতেই পারছি না। মেশিনের তীব্র শব্দ কানে ঢুকে পশুদের জান্তব চিৎকার হয়ে বেরিয়ে যাচ্ছে। চারিদিক থেকে ছুটে আসা তীক্ষ্ণ আলোতে চোখ ধাঁধিয়ে যাচ্ছে। ভালো করে চোখ খুলতেই পারছি না।
জল, একটু জল কোথায় পাই ?
লোকগুলি সব ছুটে চলছে। এতো উত্তাপ, সূর্যের এতো তেজ – কোনোদিকে তাদের খেয়াল নেই। তাদের যেন কারুরই তেষ্টা নেই। কিন্তু আমি যে কোথায় জল পাই ?
সেঞ্চুরি স্ট্যান্ডার্ড হোটেলে আমি ঢুকে পড়ি এবং একটা কেবিনে বসে পড়ি। একজন বয় এসে আমাকে জিজ্ঞেস করে, বলুন স্যার।
-- এক গ্লাস জল দাও শুধু।
-- শুধু জল ? স্যার ওটা কি মেনুতে আছে ?
-- নেই।
-- তাহলে কী দেবো ?
-- যা খুশি দাও। চা, কফি, স্কোয়াশ যা আছে সব দাও।
-- সব দেবো ?
-- দাও।
তারপর আমি চা, কফি, স্কোয়াশ, জুস – অনেক কিছুই খেয়ে বেরিয়ে আসি। তবু আমার তেষ্টা আর যায় না। আবার চক্কর দিতে থাকি রাস্তায় রাস্তায়। জলের খুঁজে। তেষ্টা বেড়েই চলে। হাঁটতে হাঁটতে আমার নজরে পড়ে, এ্যাপোলো রেস্তরাঁর দিকে। ভেতরে ঢুকে আমি আবার কেবিনে গিয়ে বসি। অর্ডার নিতে আসা লোকটিকে বলি জল দাও। লোকটা চলে যায়। কিছুক্ষণ পর একটা গ্লাস এনে টেবিলের ওপর রাখে। রঙিন পানীয়ের গ্লাসটিকে দেখে আমি জিজ্ঞেস করি, এটা কী?
-- জল।
-- আমি তো এই জল বলিনি।
-- এছাড়া আমরা অন্য জল চিনি না।
-- জল চেনো না ?
-- হ্যাঁ হ্যাঁ মশাই, আমরা অন্য জল চিনি না।
আমি টুক করে দাঁড়িয়ে বেরিয়ে আসি। পেছন থেকে খিস্তি ভেসে আসে।
কিন্তু আমি যে জল কোথায় পাই ? তেষ্টায় আমার বুক ফেটে যাচ্ছে।
সামনে একটা থার্ড ক্লাস জাতীয় হোটেল দেখে আমি আবার ভেতরে ঢুকে পড়ি। ম্যানেজার আমাকে দেখে বলে ওঠে, বলুন স্যার, আপনার জন্যে কী করতে পারি ?
আমি বলি, কিছুই করতে হবে না। আমি শুধু এক গ্লাস জল খেতে চাই।
-- জল ! পাগল নাকি! এটা থাকার হোটেল। এখানে জল নেই। কোত্থেকে যে এসব উটকো লোক ঢুকে আসে।
-- হ্যাঁ হ্যাঁ থার্ড ক্লাস হোটেলের থার্ড ক্লাস লোকদের কাছে কেনোই বা জল থাকবে! বলেই আমি বেরিয়ে আসি। লোকটা আমার দিকে হাঁ করে তাকিয়ে থাকে।
রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতে আমি টের পাই, পা যেন আর চলতে চাইছে না। কিন্তু আমি যে কী করি এখন!
হঠাৎ পেছন থেকে এক মেয়েলি কণ্ঠের ডাক শুনতে পাই, একটু দাঁড়াবেন? ফিরে দেখি এক সুন্দরী মহিলা দাঁড়িয়ে আছেন। আমাকে ফিরে দাঁড়াতে দেখে মহিলা বলে ওঠেন, কি খুঁজছেন আপনি?
-- জল। আমি খুব তৃষ্ণার্ত।
-- জল! আসুন আমার সঙ্গে।
মহিলা আমাকে কাছের একটা ফ্ল্যাটের খুব সুন্দর ড্রয়িং রুমে বসিয়ে দিয়ে একটা খুব সুন্দর ঝকঝকে গ্লাস নিয়ে এসে আমার দিকে এগিয়ে ধরে। আমি জিজ্ঞেস করি, এটা কী ?
-- আপনি যা চাইছেন।
-- আমি তো এটা চাই নি।
-- আপনি কী চাইছেন তাহলে ?
-- জল।
-- এটা তো জলই।
-- না, এটা না।
মহিলা আমার দিকে চোখ গোল করে তাকিয়ে থাকে। তারপর বলে, পাগল কোথাকার। চলে যাও এখান থেকে। বলে আমাকে বের করে দিয়ে ভেতর থেকে দরজা বন্ধ করে দেয়
এই সময় দেখি একজন ফিটফাট পোশাক পরা ভদ্রলোক আমার দিকেই আসছে। আমি বলে ওঠি, একটু শুনবেন?
লোকটি দাঁড়ায়। উত্তর দেয়, বলুন।
-- এই শহরে জল কোথায় পাওয়া যাবে ?
লোকটি কোনো উত্তর না দিয়ে তাড়াতাড়ি চলে যায়। তা দেখে একজন পথচারী এগিয়ে এসে আমাকে জিজ্ঞেস করে, কী খুঁজছেন ?
-- জল।
-- আসুন।
আমি লোকটার পেছন পেছন যেতে থাকি। লোকটা আমাকে একটা ঘরে বসায়। তারপর আমাকে একটা গ্লাস এগিয়ে ধরে। আমি জিজ্ঞেস করি, কী এটা ?
-- জল।
-- না। এটা জল নয়।
-- পান করুন। তৃষ্ণা চলে যাবে।
-- না।
আমি তাড়াতাড়ি বাইরে বেরিয়ে আসি। জল, আমার জল চাই। আমি খুব তৃষ্ণার্ত।
সামনে একজন যুবককে দেখে আমি বলে ওঠি, শুনবেন একটু।
-- বলুন।
-- এখানে জল কোথায় পাওয়া যাবে।
-- জল ? জলে জলাকার এই শহর। যেকোনো হোটেলে চলে যান।
-- পাই নি। আমি যে জল চাই সে জল পাইনি।
-- তাহলে যে জল পাওয়া যায় না, সেটা খুঁজছেন কেন ?
যুবকটি চলে যায়।
একজন লোক আমাকে দেখে দৌড়ে এসে জিজ্ঞেস করে, কী খুঁজছেন ?
-- জল খুঁজছি।
-- পাবেন না। অনেক আগে থেকেই পাওয়া যায় না। তবু আপনি উনার কাছে খোঁজ নিতে পারেন। বলে লোকটা একজন বৃদ্ধলোকের দিকে আঙ্গুল তুলে দেখিয়ে দেয়।
আমি তাড়াতাড়ি বৃদ্ধলোকটির দিকে এগিয়ে যাই। আমাকে দেখে উনি বলে উঠেন, আসুন আসুন। কী চান বলুন।
-- দয়া করে আমাকে একটু জল দিন।
-- জল ? আচ্ছা বসুন।
আমি কাছে গিয়ে বসি। উনি আমাকে নিচু গলায় জিজ্ঞেস করেন, জল খুঁজছেন ?
-- হ্যাঁ। সারা শহর খুঁজেই আপনার কাছে এলাম।
-- কেন জল খুঁজছেন ?
-- আমি খুব তৃষ্ণার্ত।
-- সত্যিই তৃষ্ণার্ত ?
-- হ্যাঁ, খুউব। আপনার কাছে যদি থাকে দয়া করে দিন।
-- আমার কাছে কোত্থেকে থাকবে ? জল দেবার ক্ষমতা থাকলে কি আমি এভাবে থাকতাম! শহরে আপনি জল পাবেন না। কোনোখানেই না। শহর তৈরি করার সময় সমস্ত নদীর পাঁপড়িগুলি শুকিয়ে ঝরে গেছে। তবে শহরটা পেরিয়ে গেলে জল পাওয়া যেতে পারে। পারবেন যেতে ?
-- পারবো। অবশ্যই পারবো।
আমি বেরিয়ে পড়ি। কিন্তু আমি যেন এক ধাঁধার মধ্যে পড়ে যাই। শহরের মধ্যে আমি শুধু পাঁক খেতে থাকি। বেরুবার রাস্তা আর খুঁজে পাইনা।
অবশেষে আমি শহরের শেষ প্রান্তে এসে যাই। কিন্তু আমি পার হতে পারি না। চারিদিকে শুধু ইটের সারি। উঁচু উঁচু সারি। চেষ্টা করেও আমি ডিঙোতে পারি না।
জল, আমার জল চাই। আমি খুব তৃষ্ণার্ত। আমার জল চাই-ই। এই শহরে, এই রুক্ষ ইটকংক্রিটের ভেতরে আমার জল নেই। ইটের সারি পেরোলেই হয়তো জল পেয়ে যাবো। সত্যিই পেয়ে যাবো।
আমি কতোকাল ধরে তৃষ্ণার্ত। কী করে আমি জল পাই। আমার যে জল চাই।

( য়ুমলেম্বম ইবোমচা মণিপুরের একজন বিশিষ্ট কবি ও গল্পকার। জল গল্পটি লেখকের একাডেমি পুরস্কারপ্রাপ্ত (১৯৯১) ছোটগল্পের বই “নুমিত্তি অসুম থেঙজীল্লকলি” থেকে নেয়া )


                                                                                                                                     HOME

SHARE THIS PAGE!