ছোটগল্প

ঈশানকোণ একটি বাংলা সাহিত্যের ওয়েবব্জিন জুলাই-আগস্ট সেপ্টেম্বর ২০১৮ সংখ্যা

ইচ্ছে আখ্যান
বৈদূর্য্য সরকার

   পাঁচমাথার মোড় দৌড়ে ক্রস করতে গিয়ে সুজন লক্ষ্য করলো – এর’ম ক্রসিংয়ের সামনে থেকে ছিটকে বেরোয় বাইক আরোহীর দল, অশ্বারোহী সৈনিকের মতো হুড়মুড় করে। উপমাটায় অবশ্য ওর নিজেরই হাসি পেল। ওকে এজন্যেই নীলাঞ্জনা বলতো “তুই মাইথোলজিতেই আটকে রইলি”। কথাটা মনে পড়তে বেশ আনমনা হয়ে গেল সুজন। সেই ভ্যাবলা অবস্থাতেই ঢুকে পড়লো হরিদাস মোদকের দোকানে। এরা এখনও টেবিলে কলাপাতা পেতে দেয়। লুচি তরকারি আর ছানার জিলিপি সুজনের মনে হল – কেন যে লোকে পিৎজা প্যাটিসের পেছনে কয়েকশো টাকা খরচ করে কে জানে! এইতো দিব্যি পঞ্চাশ টাকায় রাতের খাওয়া হয়ে গেল। রাতটা ট্রেনে দিব্যি কেটে যাবে। কলকাতা স্টেশনের দিকে রওনা দিল, কাল সকালে বারাউনি পৌঁছতে হবে।
সবসময়েই তাই করে ও। বিহার ঝাড়খণ্ডে গিয়ে লিট্টি খায়। মনে আছে, প্রথম ঘিয়ের লিট্টি খেয়ে একেবারে আক্কেলগুড়ুম অবস্থা হয়েছিল। যদিও কলকাতার কাউকে সেকথা বোঝানো যায় না। সুজনের আশ্চর্য লাগে, এখানকার লোকেরা যে কী যুক্তিতে এখনও উন্নাসিকতা বজায় রেখেছে কে জানে। একলা থাকলে ও নিজের মনে বিড়বিড় করে – এই করেই কম্যুনিটিটা শেষ হয়ে গেল। বড় বড় সরকারি প্রতিষ্ঠানে গিয়ে ও দেখেছে আধিকারিকরা হয় বিহারি নয়তো রাজস্থানি বা সাউথ ইন্ডিয়ান। ও অনেকের মুখে শুনেছে, “আগেকার সেই দাসবাবু বা ব্যানার্জীসাহেবের সময় আর নেই”। তা সত্ত্বেও ইস্টার্ন ইন্ডিয়ার বেশ কিছু লোকের মনে এখনও কলকাতা সম্বন্ধে বেশ উচ্চ ধারণা। যদিও সেটা কলকাতায় থাকা লোকেদের মধ্যে তেমন নেই। এখানে সবাই জন্ম থেকেই শেখে – হয় বিদেশ কিংবা ব্যাঙ্গালোর হায়দ্রাবাদ না যেতে পারলে জীবন ব্যর্থ। সুজন লক্ষ্য করেছিল, বাঙালি কলকাতার বাইরে থাকলে যত সহজে বাঙালিত্ব ঝেড়ে ফেলে দেয়, অবাঙালিরা কিন্তু তত সহজে বাঙালি হয় না। তারা তাদের পারিবারিক স্ট্রাকচার মেনটেন করে শেষপর্যন্ত।
ট্রেনে উঠে এসব ভাবতে ভাবতে নিজের মনে হাসছিল সুজন। অন্তত তার মুখে এসব কথাবার্তা একদমই মানায় না। একটু বড় হওয়ার পর থেকে অজান্তেই সে সামাজিক জীবন অ্যাভয়েড করে চলেছে। বাবা মা’র বাইরে অন্য আত্মীয়স্বজনদের সাথে পারতপক্ষে যোগাযোগ রাখে না। সবার সম্পর্কেই খানিকটা তাচ্ছিল্যভাব আছে ওর – ‘কেউ কিছুই বোঝে না’। কেউ জানেই না ও কিভাবে প্যাসেঞ্জার ট্রেন ধরে ভোররাতে বাড়ি ফেরে, কখনও জায়গা না পেয়ে বাসের মাথায় মাঝরাতে হুহু হাওয়ার মধ্যে নট নড়নচড়ন হয়ে বসে থাকতে বাধ্য হয়। তবু এই সময়গুলোতে ওর তেমন অভাববোধ হয় না, সবসময়েই দেখে বেশ কিছু লোক ওর মতো অবস্থাতেই আছে। তারাও ওর মতো নিশ্চিত নয় – প্ল্যাটফর্মে রাত কাটাতে হবে নাকি আস্তানায় ফিরতে পারবে। রাতের দুনিয়ার সম্ভবত কোনও কুহক মায়া আছে। গভীর নেশার মতো তাতে সবাই বিভোর হয়ে থাকে।
সে মায়া সুজন সম্যক বুঝেছিল একবার টাটায়। সেবার বাধ্য হয়ে একটা ছোট হোটেলে রাত কাটাতে হয়েছিল। হোটেলটার একটা ফ্লোরে ও একা থাকার জন্যই বোধহয় প্রথম থেকেই একটু অস্বস্তি হচ্ছিল। রাত বাড়ার সাথে নিঝুম হয়ে যাওয়া চারপাশে আশ্চর্যভাবে জেগে উঠলো হাঁটাচলার শব্দ, খেয়াল করে সুজন বুঝল শব্দটা ওর আশপাশেই। বিরক্ত হয়ে আলো জ্বেলে দেখলো – ওর জুতোটা চলার মতো ভঙ্গিতে ঘরের মাঝমধ্যিখানে পড়ে আছে। ভয়টয় নয়, ওর মনে হয়েছিল – দিনরাত এত হাঁটাহাঁটি, সে অভ্যেসেই হয়তো জুতোটা একা একা হেঁটে ফেলেছে। অন্য কেউ হলে যেখানে ভয়ে মরতো, ও নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে পড়েছিল তারপর।

বহুবারের মতো আজ একা ট্রেনে যাওয়ার সময় সুজনের মনে হতে লাগলো – সবাই এসব শুনে বলে, প্রভূত সম্ভবনা থাকা সত্ত্বেও ওর জীবনটা হয়েছে ‘না ঘরকা না ঘাটকা’! বাকিদের সাথে মিলেমিশে থেকে নিশ্চিন্ত কোনও চাকরি করতে পারে না, আবার যে কাজটা করে – এই যাযাবরের জীবনেও আর পেরে উঠছে না শারীরিকভাবে । যদিও ও ছোট থেকেই বাঙালির আবহমান ভ্যাদভ্যাদে জীবনকে অপছন্দ করে এসেছে। তাই কলেজজীবন থেকে অ্যাডমায়ার করা ফ্ল্যামবয়েন্ট জীবনের প্রতি টান এতদিনেও কাটলো না ওর। লোকে শুনে অবাক হয় –ভোরে রাঁচি থেকে ফিরে হাওড়া স্টেশনে বাথরুম সেরে কারেন্ট টিকিট কেটে সুজনকে অনেকসময়েই রওনা হতে হয়েছে গুয়াহাটির উদ্দেশ্যে।
ইস্ট জোনের বিভিন্ন ফ্যাক্টারিতে ওদের কোম্পানির বসানো ইন্সট্রুমেন্টের মেন্টেনেন্সের দায়িত্ব ওর। অতিরিক্ত হিসেবে নর্থ-ইস্টের কিছু জায়গা। মাঝে মাঝে মনে হয়, রাজাবাজার থেকে পাশ করার আগে দুনিয়াটাকে এমনভাবে ভাবেনি ও। তখন ছিল খানিকটা স্বপ্নময় দিন, চারপাশে প্রিয়ার সুবাস। প্রথমে সে নিজেকে নিয়েই ব্যস্ত থাকতো। আস্তে আস্তে ঘনিষ্ঠতা। এখন সে অতীত এক্সট্রা লার্জ হয়ে সুজনের স্বপ্নে ফিরে ফিরে আসে। একা একা কোথাও গেলেই যেন বেশি করে মনে পড়ে পুরনো সব কথা।
সেসব কথা যে এতটা অভাববোধ তৈরি করবে তখন মনে হতো না। কেননা তখন নিজের বেঁচে থাকাটাই ছিল বেশ রোমাঞ্চের। শরীরে নানারকম খিদে। ঘরের বাইরে চোরা টান। পোস্ট গ্রাজুয়েট ডিগ্রির সময় সকালবিকেল বিভিন্ন প্রান্তে টিউশানির দৌড়দৌড়ির মধ্যে কিভাবে যেন এসে পড়েছিল নীলাঞ্জনা। কয়েক মুহূর্তের দেখাতেই মিটে যেত সব চাহিদা। সুজন ওর নামটা ছোট করে বলতো নীলা। শুনে নীলাঞ্জনা বলতো, “জানিস নীলা সবার সয় না”। তখন ও কলেজ শেষ করে কি একটা ছোটখাটো কাজ করে। তাতে অবশ্য সুজনের কোনও আগ্রহ ছিল না।
পরিচিত বন্ধুমহলে সুজন বেশ জনপ্রিয় ছিল। কারণটা ছিল বাকপটুতা, যেকোনও লোককে ও অকাট্য যুক্তির জালে ফাঁসিয়ে দিতে পারতো। ওর মধ্যে একটা নিশ্চিন্ত ভাব ছিল যে, কালে কেউকেটা কিছু একটা হবে। কিন্তু তার মধ্যেই নীলাকে হারাতে হল। অসহ্য রাগ হয়েছিল ওর, মারাত্মক একটা কষ্ট। যদিও তখন কিছু করতে পারবে না জানতো। কোনওক্রমে একটা চাকরি পেয়েছে – সেটার ভরসায় সংসার পাতা যায় না। নীলাকে ব্লক করেছিল, ওর ফোন ধরতো না। কেননা নীলার মেসেজ বা পোস্ট দেখে মনে হত – ওকে বিদ্রূপ করার জন্যই এসব। বুঝতে চাইতো না, নীলার কোনও উপায় নেই। ওর বাবা আগেই মারা গেছিল। আর কৈশোরের এর’ম কতশত প্রেম যে পরিণতি পাবে না – সেটাই তো স্বাভাবিক। সেকথা ও স্বীকার করতে চাইতো না। যদিও নীলার চলে যাওয়ার সময়েও কারোর কাছে কিছু বলেনি, পুরোটাই চেপে রেখেছিল নিজের ভেতর।
সেটাই ওর কাছে স্থায়ী হয়ে আছে - কেননা ঠিক ওইরকম কোনও মেয়ে আর চোখে পড়ে না, মনে ধরে না। তাই সবকিছু সত্ত্বেও ইদানীং ওর মনে হয় – সেসময়ের সবটাই বোধহয় শক্তিক্ষয় ছিল। ছোটখাটো পত্রিকায় লেখা ওর গল্পগুলো কোথায় হারিয়ে গেছে। গিটারটাও পাশের পাড়ার একটা ছেলেকে বেঁচে দিয়েছিল আগেই। সাইকেলটাও স্ক্র্যাপ হয়ে গেছে। সুজনের শখ বলতে টিকে ছিল বিভিন্ন দেশের ফিল্ম দেখা - ডাউনলোড করে কিংবা সিডি কিনে। নিজেকে বিভিন্ন দেশের বিভিন্ন গল্পে বিভিন্ন চরিত্রে কল্পনা করতো সুজন। এখন ওর স্থির হয়ে বসার কোনও উপায় নেই তাই ইচ্ছেরাও শুকিয়ে যাচ্ছে। এখন কিছুই মনে থাকে না। ক্রমশ সিস্টেম তাকে গিলে ফেলছে। ভাবনাচিন্তার শক্তি হারিয়ে ফেলছে, পড়াশোনার বদলে স্টিরিওটাইপ কাজকর্মে অভ্যস্ত হয়ে যাচ্ছে। নিজেকে মনে হয় প্রাচীন কোনও সেনাবাহিনীর ঘোড়সওয়ার দলের লোক, যাদের কাজ একটাই –অনন্ত ছুটে চলা।

সেদিন সকালে পৌঁছে থেকে নানারকম কাজ। সেটআপে একটা মেজর ফল্ট। সন্ধে সাতটা পর্যন্ত অনেক কষ্টে ব্যাপারটা ম্যানেজ দিল ও। তারপর আর শরীর বইছিল না। বেশি খোঁজাখুঁজি না করে, যে হোটেলে বরাবর থাকে সেখানে এসে চেনা লোকটাকে দেখতে পেল না। তার জায়গায় পাতলা চেহারার একটা ছেলে। ছেলেটার জিজ্ঞাসু দৃষ্টি দেখে বেশ বিরক্ত লাগলো ওর। তাই ঠিকমতো কোনও জবাব দিল না। বরং মাথার মধ্যে কি যেন একটা হল, বলে বসল – “একজনকে খুঁজতে এসেছি ... সে এখানেই কোথাও আছে”। ছেলেটা রান্নাঘরে থাকা কারো সাথে পরামর্শ করে এসে ওকে ঘর খুলে দিল ।
চান সেরে ঘরে বসে সুজন যখন বিয়ার খাচ্ছিল ছেলেটা ঘরে এসে ওকে নানা কথা জিজ্ঞেস করতে লাগলো আর আশ্চর্যজনকভাবে ওর বানানো উত্তরগুলোয় সে বেশ কনভিন্সড হয়ে যাচ্ছিল। সুজন বলল – “নীলা নামের একটা মেয়েকে ও খুঁজতে এসেছে। ও খবর পেয়েছে এখানেই কোথাও সে লুকিয়ে আছে একজনের সাথে”। বলতে বলতে সুজন খেয়াল করলো ছেলেটা বেশ চোখ বড় করে শুনছে, হয়তো পুরো এলাকা জুড়ে এর’ম কাউকে দেখেছে কিনা মনে করার চেষ্টা করছে। তবে ওর এসব বানানো এলোমেলো কথা বিশ্বাস করছে বলে ছেলেটার প্রতি কেমন কৃতজ্ঞতা হচ্ছিল সুজনের। সে ছেলেটাকে আধ বোতল বিয়ার দিয়ে ফেলল।
তখনও বুঝতে পারেনি ছেলেটার কৃতজ্ঞতাবোধ কতটা ভয়ানক। যখন বুঝতে পারলো তখন বেশ টলটলে অবস্থা সুজনের। খাওয়াদাওয়া করে শুয়ে ঘুমিয়ে পড়ার পর হঠাৎ একটা শব্দে ঘুম ভেঙে গেল। অন্ধকারের মধ্যে শুনতে পেল তলার ফ্লোর থেকে বেশ একটা প্রাণঘাতী আর্তনাদ। দ্রুত নীচে নেমে এসে শুনতে পেল গোঙানি ও কান্না মেশানো একটা মেয়ের গলা। খেয়াল করে বুঝলো দেহাতি হিন্দিতে মেয়েটা কাউকে শাপশাপান্ত করছে। কিছুটা এগিয়ে বুঝলো হোটেলের ছেলেটার কাণ্ড এটা। সম্ভবত তার বউকে মারধোর করছে। বিরক্তি লাগলেও ব্যাপারটা ঠিক সেই মুহূর্তে বুঝতে পারলো না সুজন। খানিকটা এগিয়ে দেখলো মাটিতে পড়ে মেয়েটা চিৎকার করছে আর ছেলেটা একটা ভুল করে ফেলেছে এমন ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে আছে চুপ করে।
ওদের কথা কানে একটু সয়ে গেলে সুজন যা শুনলো – চমকে ওঠার মতোই ব্যাপার। মেয়েটা এই হোটেলের আগের লোকটার বউ। এই ছেলেটা যে করেই হোক লোকটাকে যে শুধু ভাগিয়ে দিয়েছে তাই নয় - একেও ভুলিয়ে এনেছে। প্রণয়ঘটিত ব্যাপার সোসাইটির এই লেয়ারে এর’মই ঘটে জানতো সুজন কিন্তু এটা জানতো না ওর বানানো কথার সূত্রে এদের জীবনে কি অশান্তি নেমে আসতে পারে। ছেলেটা সুজনের কথার অস্পষ্ট ইঙ্গিতে ভেবেছে ওদের ব্যাপারটাতেই সুজন খোঁজ করতে এসেছে। তাই ছেলেটা ওর প্রেয়সীকে হারানোর ভয়ে সব ফেলে এখান থেকে আজ রাতেই পালিয়ে যেতে চেয়েছিল। কিন্তু যে কোনও কারণেই হোক মেয়েটা বাধা দেওয়ায় এই বচসা। শুনে সুজনের বেশ অপরাধবোধ হতে লাগলো, তার থেকেও নিজের ওপর খানিকটা অনুশোচনা হতে লাগলো – ও কোনোদিনও নীলার জন্য কি এর’ম কিছু করতে পারতো!
কিছুটা কথাবার্তা বলে বুঝতে পারলো ছেলেটার কনফিউশান হয়েছে – নীলা নামটাতেই। অদ্ভুত ব্যাপার এই মেয়েটার নাম - নীলু। কে জানতো, এখানে মেয়েদের নাম নীলু হয়! ওর জড়ানো জিভের উচ্চারণে নীলাকে এই ছেলেটার নীলু শোনা আশ্চর্যের কিছু নয়। কিন্তু ওকে যে কেউ এর’ম দণ্ডমুণ্ডের কর্তা ভাবতে পারে, সে বোধটাই ছিল না সুজনের।
ওদের যে কোনও ভয় নেই – এটা বোঝাতে বেশ বেগ পেতে হল সুজনকে। বেশি ঝামেলায় না গিয়ে সুজন ওদের বলল, “ও অন্য একজনকে খুঁজছে”। তারপর নিজের ঘরে এসে নির্ঘুম রাতটা কাটিয়ে যত দ্রুত সম্ভব বেরিয়ে পড়ল। ভোরের ট্রেনে বাড়ি ফেরার সময় সুজনের বারবার মনে হচ্ছিল – ‘কোন গল্প যে কোথায় গিয়ে শেষ হয়, কে রাখে তার হদিস’।
                                                                                 HOME

এই লেখাটা শেয়ার করুন