ছোটগল্প

ঈশানকোণ একটি সাহিত্যের ওয়েবজিন শরৎ পর্যায় অগাস্ট-সেপ্টেম্বর ২০১৭ ইং 

[ঈশানকোণ নতুন সংখ্যা দেখার জন্যে এখানে ক্লিক করুন]

উপলব্ধি
শ্রীয়া ঘোষ সেন 


সকালবেলা ঘুম থেকে উঠে মনটা আজ ভারি খুশি ওলির। আজ থেকে একমাস স্কুলে গরমের ছুটি!
নিজের মনেই আউড়ে নিল তার অতি প্রিয় দুটো লাইন, ছুটি-ছুটি, গরম-গরম রুটি। এর মধ্যেই মায়ের হাঁক, “ওলি, শিগগির দুধ খেয়ে সামার ভ্যাকেশনের হোম টাস্কগুলো শুরু কর, অনেক টাস্ক আছে। প্রথম থেকে শুরু না করলে, কমপ্লিট হবেনা।”
ইস্! খোস মেজাজে যেন ভাঁটার টান, এখনই পড়তে বসতে হবে!
মনে মনে শিউড়ে উঠলেও, মায়ের কথা ওলি কখনই অগ্রাহ্য করেনা। তাই ঝটপট দুধ খেয়ে, একটু ভারাক্রান্ত মনে পড়ার টেবিলে বসল গিয়ে।
পড়তে পড়তে প্রায় একঘন্টা হয়ে গেছে। একটু উঠব উঠব ভাবতে ভাবতেই, কাকের কা কা স্বরে সজাগ হল ওলি।
তার পোষা কাকটা হাজিরা দিয়েছে। কিন্তু যেভাবে ডাকছে, এটা ঠিক খাবার চাওয়ার ডাক নয়! যেন সামনে বিপদ দেখে, সবাইকে সতর্কবার্তা জারি করছে! তাহলে কি? ছুটে গিয়ে, বারান্দায় গিয়ে ওলি দেখে --- যা ভেবেছি তাই। শয়তানটা আবার এসেছে!
একটা সাদা-বাদামি ছোপওয়ালা বিড়ালের উদ্দেশ্যেই ওই উক্তি। কেন জানিনা, এই বিড়ালটিকে একদম পছন্দ হয়না ওলির। এমনিতে পশু-পাখিদের সাথে বন্ধুত্ব পাতানোটা ভীষণ উপভোগ্য তার কাছে। এই বিড়ালটিকেও পোষ মানাতে চেয়েছিল সে। যাবতীয় চেষ্টায় অকৃতকার্য হওয়ায়, প্রথমে মনে জমেছিল ক্ষোভ, তারপর ক্রোধ, ধীরে ধীরে যেটা ঘৃণার রূপ পেল। আর আশ্চর্যজনকভাবে বিড়ালটিও যেন জেদ ধরে ছিল, কিছুতেই পোষ মানবে না ওলির। দূর থেকে ওলিকে দেখলেই লেজ দুলিয়ে দুলিয়ে যেন একটা চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিত। এভাবেই অসম এক অন্তর্দাহ চলছিল দুজনের মধ্যে।
আজকেও ওলি দেখতে পেল, বিড়ালটা মনের সুখে বাড়ির কার্নিশে ঘুমোচ্ছে, আর সেইজন্য তার প্রিয় কাকটা চিৎকার করছে। তাড়াতাড়ি বারান্দায় লাগানো জলের কল থেকে দু-এক ছিটে ছুঁড়ল বিড়ালের গায়ে, কোন ভ্রূক্ষেপ নেই দুষ্টুটার! নিজের মনে আক্রোশ জাগল ওলির।
“দাঁড়া! দেখাচ্ছি মজা এবার!” নিমেষের মধ্যে ভেবে ফেলেছে ওলি, আজ একটা চরম শিক্ষা দিতেই হবে।
তাড়াতাড়ি বাথরুমের ছোট এক বালতি জল ভরে নিয়ে অতি সন্তর্পণে বারান্দায় এসে আচমকা পুরো বালতি উপুড় করে দিল বিড়ালের গায়ে।
গভীর তন্দ্রামগ্ন বিড়াল, এই হঠাৎ অপ্রস্তুত আক্রমণে আঁতকে ওঠায়, হাত-পা ছুঁড়তে গিয়ে বেসামাল হয়ে সরু কার্নিশ থেকে প্রথমে ভাসল শূন্যে, তারপর পড়ল গিয়ে কার্নিশের ঠিক নিচে ওলিদের অব্যবহৃত কুয়োর মধ্যে, সাথে বীভৎস এক চিৎকার --- “মিঁয়াও----ও----ওও!!”
আকস্মিক এই ঘটনায় ওলিও হতভম্ব। এই ব্যাপারটা যে ঘটতে পারে, ধারণা করতে পারেনি পাঁচ বছরের ওলি। হঠাৎ যেন তার নিঃশ্বাস গলার কাছে আটকে গেল। এরকম তো ও কখনো চায়নি। কাউকে যে ডাকবে, ভয়ের চোটে গলা দিয়ে আওয়াজ বেরোল না তার। যেন পাথর হয়ে রইল সে।
কুয়োতলার পাশেই একতলায় রান্নাঘর তাদের। এই সময় রোজই সেখানে রান্নায় ব্যস্ত থাকেন ওলির জেঠিমা “ঝপাং” শব্দটা শুনতে পেয়েই তড়িঘড়ি বেড়িয়ে এলেন। সাথে, ওলির পিসিমণিও। সবার চোখেমুখে ত্রাস আর বিস্ময়! দোতলায় বারান্দায় ওলি তখনও জড়ভরত হয়ে দাঁড়িয়ে। ইতিমধ্যে ওলির বাবাও পৌঁছে গেছেন কুয়োতলায়। বিড়ালটাকে কুয়োর মধ্যে ছটফট করতে দেখে বিব্রত তখন সবাই।
কুয়োটা অনেকদিনের অব্যবহৃত বলে বালতি, দড়ি, কিছুই ছিল না হাতের কাছে! এদিকে বিড়ালের অবস্থা কাহিল। প্রাণপণ চেষ্টা করছে ভেসে থাকার জন্য, কিন্তু গভীর কুয়োর জলে যেন থই পাচ্ছে না।
ওলির পিসি, বাবা ভীষণভাবে আফশোস করছেন --- “ইস্, বেচারা আজ বেঘোরে প্রাণ হারাবে!” কেননা বালতির জোগাড় অনায়াসে হয়ে গেলেও, মজবুত লম্বা দড়ি, সেইমুহূর্তে কোথাও খুঁজে পাওয়া গেলনা, যার সাহায্যে বিড়ালটাকে বের করে আনা যায়।
সমস্তকিছু দোতলার বারান্দা থেকে চুপ করে দেখছিল ওলি। গলা শুকিয়ে কাঠ। নিজের মনেই ভাবছিল, আজ যদি সত্যি বিড়ালটা মরে যায়, সবকিছুর জন্য দায়ী থাকবে ও। ও একজন খুনি হয়ে যাবে!বুকটা যন্ত্রণায় মুচড়ে উঠল ওলির ।
“না না, এ তো আমি কখনোই করতে চাইনি। ইস্, ঠাকুর, তুমি বিড়ালটাকে বাঁচিয়ে দাও!” মনে মনে কাতরভাবে ভগবান কে প্রার্থনা জানালো সে। বিড়ালের অবস্থা দেখে চোখ ফেটে কান্না আসছিল তার। হঠাৎ ওলির মনে পড়ল, ছাদের ধারে কিছু পরিত্যক্ত জিনিসপত্রের মধ্যে একটা “S” অক্ষরের মত বাঁকানো লম্বা লোহার শিক্ আছে, যেটায় বালতি ঝুলিয়ে, বিড়ালটাকে কুয়ো থেকে বের করা যেতে পারে। কথাটা মাথায় আসাতেই ছুটল ওলি ছাদে। তারপর সেই লোহার শিক্টা বের করে, পড়িমরি করে দৌড়ালো, কুয়োতলায় বাবার কাছে এসে শিকটা দিয়ে বলল --- “বাবা, দেখতো এটা দিয়ে ওকে বের করা যায় কিনা।” এইসময় কে জানি নাইলনের দড়ি নিয়ে এলো।
ওলির বাবা, তাড়াতাড়ি শিকের মধ্যে বালতি ঝুলিয়ে কুয়োয় ফেললেন। বিড়ালটা, হাঁকড়-পাকড় করে বালতি আঁকড়ে ধরল এবং অবশেষে তাকে কুয়োর বাইরে আনা গেল।
বাইরে এসেই এক লাফে দৌড়োল বিড়ালটা, নিরাপদ দূরত্বে গিয়ে নিজের গা চাটতে আরম্ভ করল।
ঘাম দিয়ে জ্বর ছাড়ল সবার। ওলি-র চোখ দিয়ে জল ঝরতে শুরু করেছে ততক্ষণে। তাই দেখে, পিসিমণি জড়িয়ে ধরে বললেন তাকে --- “কাঁদছ কেন সোনা? ও তো বেঁচে গেছে, আর তোমার জন্যই ওর প্রাণ রয়ে গেল। লক্ষ্মী মেয়ে আমাদের!”
বাবা, জেঠিমা প্রত্যেকেই একমত। সবাই আদর করলেন ওলিকে এবং চলে গেলেন নিজেদের কাজে।
কুয়োতলার পাশে, রান্নাঘরের সিঁড়িতে চুপ করে বসে রইল ওলি। নিজেকে ভীষণভাবে ছোট মনে হচ্ছে তার। বাড়ির সবার প্রশংসায় আরও বেশি অপরাধী লাগছে নিজেকে। ভাবছে, সত্যি কথাটা সবাইকে বলা তার উচিত ছিল। কিন্তু কিছুতেই গলা দিয়ে স্বর বেরুচ্ছে না তার, এমনকি এখনো সত্যি কথা বলতে পারছে না সে।
হাউ হাউ করে কেঁদে ফেলল সে। প্রতিজ্ঞা করল মনে মনে, আর কোন দিন এভাবে কারুর প্রতি ঘৃণা পুষে রাখবে না। কিন্তু কিভাবে এই অপরাধবোধ থেকে মুক্তি পাবে সে?
একবার ভাবল, মা-কে সবকিছু জানিয়ে দেই। মা যদি সব শুনে তাকে শাস্তি দেন, তবেই প্রায়শ্চিত্ত হবে তার।
কিন্তু কিছুটা ভয়, কিছুটা সংকোচ, তার পা দুটো যেন আটকে ধরেছে। আবার অঝোরে কাঁদতে থাকে সে হাঁটুর কাছে মুখ গুঁজে । হঠাৎ পায়ের পাতার উপর গরম নিঃশ্বাসে চমকে উঠল ওলি। তাকিয়ে দেখে, সদ্য মৃত্যুমুখ থেকে ফিরে আসা বিড়ালটা চুপি চুপি তার পায়ের কাছে এসে বসেছে। যাকে পোষ মানাতে গিয়ে এত সাধ্যসাধনা করেও সাফল্য পাওয়া যায়নি, সে আজ নিজেই ধরা দিয়েছে ওলির কাছে, হয়তো কিছুটা কৃতজ্ঞতা জানাতে।
কাঁদতে কাঁদতে ওলি তার গায়ে হাত বুলিয়ে, ফিসফিস করে বলল, “বিশ্বাস কর সোনা, তোকে আমি মারতে চাইনি। যা করেছি, না বুঝে হয়ে গেছে। আর কোনোদিন হবেনা এমন। তুই আমায় ক্ষমা করে দিবি তো? আমার বন্ধু হয়ে থাকবি তো?”
ওলি দেখল, তার চোখের দিকে তাকিয়ে বিড়ালটা একমনে কথাগুলো শুনল, তারপর কি বুঝল কে জানে! একবার আকাশের দিকে তাকালো, দুবার চোখ পিটপিট করলো, তারপর পরম আদরে ওলির হাতের আঙ্গুল একটু চেটে দিয়ে আস্তে করে বলল, “মিউ!”
                                                                                                                                     HOME

এই লেখাটা শেয়ার করুন