ভয়
আমার শিরা উপশিরা বেয়ে নামে
তারাদের ছায়াপথের
বিন্দু বিন্দু আলো—
আকাশের কিনারায় গাঁথা অই চাঁদ
আজ বড় দুর্গম লাগে
আমার আর সাহস হয়না
শেষের সেই দৃশ্যে দাঁড়াতে
বাবার দেহ শুইয়ে রাখা বারান্দায়
ভোররাতে নীহারিকার আলো গলেছিলো
তখনও তার দাগ লেগে রয়েছে তাঁর শরীরে
আমি দেখলাম মায়ের ভাঙা শাঁখা পড়ে আছে
প্রিয় বকুল বৃক্ষের তলায়
পাশের দীঘির জলতরঙ্গে
রাক্ষুসে মাছের মুখ হাঁ করা
বকুলগাছের মাথায় থ্যাবড়ানো সূর্যে
মায়ের সবটুকু সিঁদুর লাল হয়ে আছে
সাদা থানে ঢাকা বিধবার সাজ জুড়ে
নেমেছিলো দুর্গম চাঁদ জোছনা নিয়ে
আমি আকাশের উল্কাবৃষ্টি ঢকঢক্ করে
পান করেছিলাম সেই রাতে
মা শুয়েছিলো সমুদ্রের উপরে
সকাল এসেছিলো আকাশের তলায়
এসেছে দুপুর, বিকেল, সন্ধ্যে
সব প্রহর বয়েছে নিয়মের সন্ধি মেনে
শুধু আসেনি ফিরে চেনা মানুষটার ঘ্রাণ
মা দাঁড়িয়ে আছে চেনা দরোজায়
বকুলতলায় ছড়িয়ে আছে
ফুলের সাথে মায়ের সাদা শাঁখা
এমন কঠিন দিনের আলোয়
চোখ ধাঁধিয়ে যায় মানুষের
মা তবু দাঁড়িয়ে আছে আকাশের মত
তলায় মেঘের ছায়া দীঘির নিটোল জলে
বুকের এতোটা কাছে জ্যোৎস্না নেমে এসেছে
ভয় লাগে চাঁদমুখো করোটিকে
কেউ জানেনা, আমি আর
সেরকম শেষের সকাল চাইনা
বসন্ত রেণু
প্রিয় সুনীল,
তোমার তারা-রঙ চোখ বেয়ে নেমে আসে
হলুদ নীল প্রজাপতির উড়ন্ত ঝাঁক
ওদের পাখায় ভর করে চলে যায় শীতকাল
এখানে মুক্তো গুঁড়োর মতো কুয়াশা ঢেকেছে শহর
উরুতে আঁকা বেগুনী টিট্রিভ পাখিটা উড়ে যায়
তোমার পাড়ায়, ব্যালকনির এক চিলতে রোদ্দুরে
বসন্ত আসবে বলে।
আমি বসে থাকি এলো চুলে, বাসন্তী শাড়িতে
ঝরা পাতার হলুদ-ভাবনায়
তোমার বাড়ি যাওয়ার পথ ভুলে গেছি
আমার উরুতে আঁকা পাখিও উড়ে গেছে
সমস্ত কিছু ভুল হয়ে গিয়েছে
ছিঁড়ে গেছে পায়ের সোনালি ঘুঙুর
মাথায় পুরনো মেঘের আকাশ নিয়ে
বাড়ি ফিরে এলাম আমলকী চাদর গায়ে
এখন আমাকে জড়িয়ে শেষ শীতের আইভি লতা
নাকে আসে মায়ের শরীর জোড়া অসুখের ঘ্রাণ,
গাঙুরের ঘোলা জলের মতো
তার বড় বড় ফ্যাকাশে চোখ
চিত্রাঙ্গদা হারিয়ে গেছে এই শহরের গলিতে
আমার কিচ্ছু ভালো লাগেনা ওহে বন্ধু, প্রিয়তম
এরপরের শীতে যদি
বসন্ত নিয়ে আসে আম্রপালীর ভ্রমর
আমার পর্ণমোচির কমলা ভাবনাগুলো
তোমার ব্যালকনির রোদের 'পরে পাঠিয়ে দেবো
তুমি অই কমলা পাতায় অংক কষে বলো
আর কতোকাল আমি এভাবে
বসন্তের প্রতীক্ষায় দিন কাটাবো
— নীরা
নারী
সে কি আমাকে কখনো চোখ তুলে দেখেছিলো
বালিহাঁসের মত উড়ে উড়ে ছুঁয়েছিলো কি
আমার অপমানে শতচ্ছিন্ন শাড়ির আঁচল
তার কিশোর বাতাস এখনও কি জেগে আছে,
ঝড়ের দুপুরে বীরপুরুষের মত কুড়িয়ে আনা
কাঁচামিঠা আমের গাঢ় সবুজ রক্তের ঘ্রাণ,
সে কি আজও নদীর কাছে আসে পলির নরম
হৃদয় নিয়ে, ধানের শিষের রঙ গায়ে মেখে
কুয়াশায় ছেয়ে গেছে চেনা নগরীর অলিগলি
বছরের পর বছর কেটে গেলো ইলোরার গুহায়
যে রাতে নগ্ন হয়েছিলো নদীর বিপন্ন ঢেউ
সে রাতে আমার শাড়ি হতে চেয়েছিল অসুস্থ মেঘ
দু’হাতের মুঠোয় লুকিয়ে প্রেম, ফুটপাতে শুয়ে পড়ি
শেষ অপরাজিতার ঘুমে, আমার ঘুমের মধ্যে
তোলপাড় হলো নদীর তরঙ্গ সারারাত ধরে
তবু ওরা ভাঙতে পারেনি আমার জলের শরীর
অনেক বছর পরে আবার নতুন জন্মে ফিরেছি
চেনা পাড়ার গলিতে, আমার ফিরোজা শাড়ির
নকশায় মাছরাঙা এসেছে ফিরে চেনা শাখায়
গ্রীবার মুক্তোছড়ায় জমা হয়ে আছে বেদনার নীল
খোঁপার পলাশ পাপড়িতে পূর্বজন্মের আঁচড়ের দাগ
আজ কপালে যত্ন করে এঁকেছি তীব্রতর তৃতীয় নেত্র
আমি ফিরে এসেছি, গর্ভে মানুষের জন্ম দেবো বলে
এই লেখাটা শেয়ার করুন