ছোটগল্প

ঈশানকোণ একটি সাহিত্যের ওয়েবজিন শরৎ পর্যায় অগাস্ট-সেপ্টেম্বর ২০১৭ ইং 

[ঈশানকোণ নতুন সংখ্যা দেখার জন্যে এখানে ক্লিক করুন]

কিছু পলাশের নেশা
নীতা বিশ্বাস

দক্ষিণা যতই হোক, দখিনা বাতাস খেলে যায় বুকে, তার ঘর লাগোয়া বাথরুমের অসহ্যসুন্দর বাথটাবটা দেখে। এ তমালেরই কারসাজি, বুঝে ফেলে অনন্যা। কবে কোন অন্যমনস্ক ক্ষণে বোঝাবুঝি হয়ে যায় যে দুজনকে দুজনার। সেদিন ওদের নতুন ফ্ল্যাটটার চাবি হাতে পেয়েছে। ‘চমক আছে তোমার জন্য’—তমাল বলেছিল। এই সেই বিস্ময়সুন্দর চমক।
বাথটাবের ওভাল শেপ ঘিরে আকাশ-নীল বাল্ব। জ্বললেই জল ভরা টাব মুহূর্তে কোভালাম সি।
যেন উদাসীন তমাল, ‘ঠিক আছে!’
অনন্যা, ‘এর রূপ দেখে মরে যাআআই!’
মরার কথা আসছে কেন! ছিঃ!
অনন্যা ততক্ষণে স্বপ্নঘোরে সেই স্বপ্নিল ঢেউ বুকে মুখে শরীরের চড়াই উৎরাই গিরিখাতে মেখে মেখে নিয়ে রোমাঞ্চিত। সেই থেকে অনন্যা-তমালের বেডরুমের এ্যাটাচড বাথে সে রাজার মত। রাজাকে দেখতে দেখতে অনন্যা সেদিন আচমকা তমালকে জড়িয়ে ধরে, ‘তুমি কি সুন্দর তমাল!’
আশ্চর্য তমাল বলেছিল, ‘সুন্দর আমি! না তোমার বাথটাব! ভালো করে তাকিয়ে দেখে বলো কে বেশী সুন্দর!’
‘দুজনেই।’ অনন্যার চোখে শীত রোদ্দুরের ঝিলমিল।
‘হায়রে’—ঘটা করে দীর্ঘশ্বাস তমালের। ‘বুঝলাম’।
‘কী আবার বুঝলে?’
‘বুঝলাম আমার যোগ্যতা তোমার কাছে নিষ্প্রাণ একটা বাথটাবের’...
‘কে বলেছে নিষ্প্রাণ! এই বুঝলে! প্রাণ আছে! প্রাণ আছে! আর সুন্দরের বাস তো মনে আর প্রাণে!’ বোঝো না!
বোঝে তো তমাল। এমনি করেই অনন্যার কথা বুঝে নেয় তমাল। ‘কিছু পলাশের নেশা, কিছু বা চাঁপায় মেশা’ এইরকম কথাই অনন্যার। এই নেশা নেশা কিছুটা বলা আর অনেকটা না-বলার সুগন্ধি আশ্লেষের মধ্যে দিয়েই তমাল তার অনন্যার ধরা অধরা আধুরা স-অ-অ-ব কথা বুঝে নেয়। অনন্যা যে অন্য জগতে থাকে! ওর কথা ভাবনারাও। এই অন্যরকম মেয়েকেই তো ভালোবেসেছে তমাল, যার গায়ের গন্ধে মাছ-মশলা নয়, সব সময়ে যুঁই কিংবা স্বর্ণচাঁপা। তবু কেমন যেন অন্যরকম এক অনুভুতি দাঁত বসাচ্ছে তমালের সাবলিমিটিতে! কেন!

লাখ টাকার কোভালাম টাব রোজ কথা কয় অনন্যার সঙ্গে। অনন্যা শোনে সেই গভীর কথালতা। বলেও জলের মত ঝর ঝর। সুগন্ধি উচ্ছলিত বাথটাবের সঙ্গে রোজ সহবাস ওর। সে যেন আরো অন্য অনন্যা। তমাল মনে মনে দেখে সে স্নানবিলাস। শোনে তার কল্লোল। মনের গভীরে এই দেখা শোনা। গভীরতা গভীরতর হয়। তার সঙ্গে আরো কিছু মেশে কি! আরো অন্য কিছু!!! তমাল নিজেকে শাসন করে। তবু অনিশ্চয়তা একদিন ছদ্ম আড়ালে কথা কয়ে ওঠে—‘ওটা ট্রেস্পাসার।’।
অনন্যা বিস্ময়ে বলে ‘ট্রেসপাসার! কোনটা?’ ছদ্ম গাম্ভীর্যে তমাল বলে,--‘অ্যান্ড আ ট্রেসপাসার মাস্ট বি প্রসিকিউটেড। ওটা আমার রাইভ্যাল। ওই, তোমার স্নাননৌকোটা। ওকে তুমি আমার চেয়ে...’। কথা শেষ হবার আগেই অনন্যা হাসির ঝর ঝর বইয়ে বলে, তাই! কি জানি! হবেও বা।’ ছল করে যোগ দেয় সে হাসিতে তমালও। এভাবে শিহরণ মুহূর্ত বড় সুন্দর আর প্রস্ফুটিত হয়ে ওঠে অনন্যার কাছে। আর তমালের কাছে?

দ্বিধাবিভক্ত তমাল প্রতিটা দিনরাত্রি কালরাত্রি যাপনের যন্ত্রণা বয়ে বেড়ায়। আর আশ্চর্য, তমাল-অনন্যার পাঁচ বছরের লিভ ইন এর প্রথম দিনটাই ছিল অনন্যার জন্মদিন। ‘হোয়াট আ কোইনসিডেন্ট’, তমাল বলেছিল, দিনটা তবে কোনো দিনই বিস্মরণের ছায়ায় ঢেকে যাবে না। ঘটা করে জন্মদিন সেলিব্রেট করেছিল, শুধু দুজনেই। আগামীকাল সেই জন্মদিন আর লিভ ইন এর পঞ্চম তিথি।
রাতে অনন্যা যখন স্বপ্নঘুমে থৈথৈ, অনিদ্র তমাল তখন জোড়া-জন্মদিনের সারপ্রাইজ গিফট সাজানো নিপুণ নিষ্ঠ নাবিক। প্রতিবারের মত। আসল গিফট সাজিয়ে এবার বাকিগুলো। অর্ডার দিয়ে বানানো বার্থডে কেক রেখেছে টেবিলে, সুগন্ধি ক্যান্ডেল। গুচ্ছ রক্তলাল গোলাপে ঝমঝম বাজছে ফ্লাওয়ারভাস। পাশে কি রজনীগন্ধার স্টিক রাখবে? ওঃ। না না। সে তো মৃ..., শিউরে উঠে মনে মনে অনন্যাকে জড়িয়ে মড়িয়ে নিজের বুকের সঙ্গে মিশিয়ে একাকার করে। চুম্বনে রক্তাক্ত অনন্যার ক্লিভেজে আশ্লেষী দাঁত বসায়। বিবসনা করে। কোভালাম বিচে রোদপোয়ানো সাদা বিদেশিনীদের পাশে কিন্তু কিছুতেই শোয়াতে পারে না। কান্না এসে খামচে ধরে তমালের চোখ। চোখ ভাবে কেন বাথটাবটা এমন নেশাচ্ছন্ন করে দেয় ওর নিজস্ব অনন্যাকে! কেন এই বিষচমক গিফট ওকে দিতে গেল তমাল! কেন ওই বিষনীল জলে শুয়ে অনন্যা তমালকে ভুলে অন্য অনন্যা হয়ে যায়! কার সঙ্গে তখন মনে মনে গোপনে...ভেবে হায় হায় করে ওঠে মনখারাপের তমাল। বিষপ্রশ্ন গুলো বিষপিন ফোটায় তমালের সারা শরীর জুড়ে। শরীর বলে ওঠে, অনন্যা তখন বিকিনি-বিদেশিনীর মত বালুচরে নগ্ন শুয়ে থাকার স্বপ্ননেশায় মাতে না তো! ভাবতে ভাবতে কেমন অসুস্থ হয়ে উঠতে থাকে তমাল। স্নায়ুতন্ত্রে তুমুল চিৎকার দাপাদাপি করতে থাকে।

রাত বারোটার কাক্কু ক্লক কুহু বাজাতেই তমাল ঘুমমাখা অনন্যার হালকা শরীরটাকে বুকে তুলে নিয়ে সাজানো টেবিলের সামনে দাঁড় করায়। পূর্ণ চোখে তাকিয়ে অনন্যা ঝলমলিয়ে ওঠে। ক্যান্ডেল জ্বালায় তমাল, টেবিলও হেসে ওঠে। সারপ্রাইজ গিফ্‌ট বার করতে করতে তমাল হ্যান্ডিক্যাম রেডি করে।
‘আরে থামো থামো, চেঞ্জ করে আসি’—চেঁচায় অনন্যা। তমাল শোনেনা। বলে, ‘এই স্বচ্ছ নাইটিতেই তো তুমি আমার। এ ছবি তো শুধু আমার জন্যেই। জীবন ভরে একে আমিই শুধু দেখবো। আর কেউ না। কেউ না। পরক্ষণেই সুর তোলে ‘হ্যাপি বার্থ ডে টু ইউ।’ তমালের এক হাতে ক্যামেরা, অন্য হাতে মোমের আলোয় দ্যুতি ছড়ানো হীরের নেকলেশ। অনন্যার পদ্মকলি হাতে নেকলেশ তুলে দেবার ছবি ক্যামেরাবন্দি হয়ে যায়। তমালের বুকেও বন্দি হয়ে যায় কি সে ছবি!
ক্যামেরার বুকে অনন্যা নামের দূরতর দ্বীপকে দেখে তমাল। ওর মনজমিতে কেমন যেন হাহাকার বেজে ওঠে। ডিপ্রেসন নামক চোরাইমশলার দুর্বল দেওয়ালের মতো ভেতরে নিঃশব্দে ভাঙতে ভাঙতে শ্বাসরোধ হয়ে আসে তমালের।
আদুরে বিড়ালির মতো অনন্যা খুনসুটি করে, ‘সকালের স্পেশাল প্রোগ্রাম টি কি?’ উত্তর দিতে গিয়ে তমালের গলায় ফ্যাকাসে উচ্চারণ। অথচ এরকম হওয়ার কথা তো ছিলো না! কথা তো কত কিছুই থাকেনা, তবু কত কিছুই তো কথা হয়ে উঠে নির্জন মনঘরে দিব্যি পিঁড়ি পেতে বসে। কোন সুদূর থেকে ফিরে এসে যেন তমাল জিজ্ঞাসু অনন্যাকে ঝাড়াঝাপটা জবাব দেয়, ‘কোনো প্রোগ্রাম নেই। অফিস আছে। জরুরি।’
‘অফিস? যাবে তুমি? কোনদিন গেছো এমন করে?’
‘যেতেই হবে আমাকে। যেতেই হবে।’
‘ও। তাই রাত জেগে এসব পাগলামি...’
কাজের চাপ এভাবে তার তমালকে গ্রাস করে নিচ্ছে ভেবে কষ্ট পায় অনন্যা। তবু পরিস্থিতি সুন্দর রাখতে ছদ্ম অভিমানে বলে, ‘দেখো, তুমি অফিস থেকে না ফেরা পর্যন্ত তোমার ওই হিংসুটে রাইভ্যাল বাথটাব থেকে উঠবোই না আমি। দেখে নিও!’
কেঁপে উঠে তমাল অনন্যার মুখে হাত চাপা দেয়। মুক্তোদানা হাসি ঝরিয়ে অনন্যা তমালের আশ্লেষময় যন্ত্রণা অজান্তে বাড়িয়ে দেয়।

ঝকঝকে বাথটাবে সেট করা টেমপারেচারে আরামদায়ক অনুপাতে গরম ঠান্ডা জল রেডি হলেই অটো স্টপ। টেকনোলজি কে ধন্যবাদ দিতে দিতে লিকুইড বডিসোপ আর ওডিকোলনের শিশি হাতে অনন্যা ওই ভরন্ত অষ্টাদশী টাবের মুখর হাতছানি দেখতে পায়। শিউরে উঠে ভরা পুকুরে নামতে যাবে, অনন্যার মোবাইল ফোন গেয়ে উঠলো, একটুকু ছোঁয়া লাগে, একটুকু কথা শুনি...
-- হ্যাঁ বলো তমাল। তুমি আমাকে শুনতে পাচ্ছো?
-- দেখতেও পাচ্ছি স্পষ্ট।
-- যাঃ! অসভ্য!
-- শোনো অনন্যা...
-- শুনছি তো। বাথরুমের ফুলসাইজ মিরার টা না তোমার মতই অসভ্য।
-- আচ্ছা ঠিক আছে। তুমি আমার কথাটা শোনো আগে...
-- তুমি কি ড্রিঙ্ক করেছো! তোমার গলা এরকম...
-- জলে নামোনি তো অনন্যা?
-- নামতে যাবো, তোমার ‘একটুকু ছোঁয়া’ বেজে উঠলো।
-- নামোনি তো? নেমোনা প্লিইইইজ...
-- তোমার জলে আমি তো কবেই নেমেছি তমাল!
-- আজ নেমোনা অনন্যা প্লিইইইজ, আমি এক্ষুণি আসছি...
-- এই, না না, একদম আসবেনা এখন তুমি। আমি এখন ‘তোমার বিরহে রহিব বিলীন, তোমাতে করিব বাস।’
একটা সহাস্য কিসিকিসি তমালকে ছুঁড়ে দিয়ে, তাড়াহুড়োতে মোবাইল ফোন সুইচঅফ না করে, বাথের দরজা খিল না দিয়েই অনন্যা জলে নেমে পড়ে। সি-ব্লু জল তমালের মতো হাত বাড়িয়ে ওকে বুকে তুলে নেয় দুরন্ত টানে। জলের থির থির কাঁপনে তমালের বক্ষলগ্ন অনন্যা রতিশিহরণে আবিষ্ট হয়ে গুনগুনায়, ‘তুহুঁ মম মাধব তুহুঁ মম দোসর’...
ফোন চেঁচিয়ে বলে, জলে নেমোনা অনন্যা... গিজারের মেন সুইচ অফ করো অনন্যা... কথা বলছো না কেন অনন্যা... আমি আসছি অনন্যাআআআআআ...
ইলেকট্রিক্যাল এঞ্জিনিয়ার তমাল গাড়িতে মরণ-স্পীড তোলে। ডুপ্লিকেট চাবিতে ফ্ল্যাটের সদর দরজা খোলে। পা কে উড়িয়ে নিয়ে আসে বাথরুমের দরজায়। আধখোলা দরজা হাট করে খুলে স্বপ্নজলে নিমগ্ন নগ্ন অনন্যার যুঁইগন্ধী অপরূপ শরীরের স্থিরচিত্রের পাশে বসে ইলেক্ট্রিক্যাল এঞ্জিনিয়ার তমাল অনন্যার স্বপ্নিল জলে বিদ্যুতবাহী তার যুক্ত করবার কৌশলী হাত দুটোকে কি পুঁচিয়ে পুঁচিয়ে কাটতে থাকে! এই দহন-ভালোবাসাও কি অনন্যার মরণকে শ্যাম সমান করে তোলে? পুলিশ কি ওদের মোবাইল ফোনের লাস্ট কল চেক করবে? তারপর???

                                                                                                                                     HOME

এই লেখাটা শেয়ার করুন