ছোটগল্প

ঈশানকোণ একটি সাহিত্যের ওয়েবজিন গ্রীষ্ম সংখ্যা মে ২০১৭ ইং 

[ঈশানকোণ নতুন সংখ্যা দেখার জন্যে এখানে ক্লিক করুন]

বীজমন্ত্র
বিশ্বদীপ দে


গতকাল রাত্রেই আমার মারা যাওয়ার কথা। এইসময় আমার নিথর দেহটা শুয়ে থাকার কথা মর্গের শীতল অন্ধকারে।
আজ একটু আগেই জানতে পারলাম ব্যাপারটা। যখন সম্রাট ওর বাইকের হেলমেটটা দেখাল, দেখেই চমকে উঠলাম। কীরকম অদ্ভুত ছেঁচড়ে গেছে। ওঃ ! মুহূর্তে স্পষ্ট দেখতে পেলাম দৃশ্যটা। দ্রুত বেগে বাইকটা এগিয়ে আসছে। চালক মদ্যপ সম্রাটের পিছনে বসে আছি আমি। নেশার ঘোরে বাম্পারটা বুঝতে পারল না সম্রাট। ছিটকে গেল বাইকটা। বাইক থেকে ছিটকে বেরিয়ে গেলাম আমি। সম্রাট বাইকসুদ্ধ এগিয়ে গেল সামনের দিকে। হেলমেট থাকায় কোনও ক্ষতি হল না ওর। স্কিট করে বেশ কিছুদূর হিন্দি ছবির নায়কের মতন গিয়ে সজোরে ধাক্কা মারল ল্যাম্পপোস্টে। লোকজন ছুটে আসছে আশেপাশের দোকান থেকে। একটু দূরে আমি। তখনও কি গোঙাচ্ছি একটু একটু, নাকি……।
ওঃ। বিরাট ফাঁড়া গেছে। ভাগ্যিস তুই দাঁড়াস নি তন্ময়। সত্যিই তাই। অথচ অন্যদিন হলে আমি হয়তো দাঁড়িয়েই যেতাম। কাল যখন সম্রাট ফোন করে বলল, ‘সে কীরে তারাতলায়! দাঁড়া দাঁড়া, আমি আসছি’। সত্যিই বেশ কনফিউজড হয়ে গেছিলাম। মনের অবস্থা এমন যে একা থাকতেই ইচ্ছা করছে অথচ পকেটের অবস্থা ভাবলে দাঁড়িয়ে যাওয়াই শ্রেয়। সম্রাটের সঙ্গে যাওয়া মানেই অটোর ভাড়াটা, মানে ছ’টাকার সাশ্রয়। মাসের বাইশ তারিখ ছ’টাকার মায়া বড় কম নয়। কিন্তু একা থাকবার ইচ্ছেটা এতই প্রবল ছিল শেষ অবধি না-ই করে দিয়েছিলাম, আরে আমার অটো এসে গেছে। আমি বেরিয়ে যাচ্ছি ...
সম্রাট বাইকে স্টার্ট দিয়ে বলল, নে এবার বস। ভয় নেই। আজ আমি একফোঁটাও খাইনি। আর আমরা তো ক্লাব পর্যন্ত যাব। জাস্ট দু’মিনিটের পথ। চলে আয়।
--- নারে, আমি ক্লাবে যাব না। একটু নিরুপমদের বাড়ি যাব।
কথাটা শুনেই খ্যাঁক খ্যাঁক করে হাসতে লাগল সম্রাট, ‘তুই বোধহয় আর কোনওদিনই বাইকে চড়বি না। আবে গাণ্ডু এই দ্যাখ পিছনের হেলমেট। তুই না হয় পরেই নে শালা ডরপোক। হেলমেট থাকলে তো আর...
--- আমি ক্লাবে যাওয়া ছেড়ে দিয়েছি।
--- দূর শালা। থাক তুই। আমি বেরিয়ে গেলাম। বহুৎ টায়ার্ড লাগছে। একটু পুরিয়া না খেলে...
মুখের ওপর ধোঁয়া ছেড়ে এগিয়ে গেল সম্রাট। আর আমি হাফ ছেড়ে বাঁচলাম। ক্লাবে সম্রাটের অনেক চ্যালা চামুণ্ডা আছে। এই দামি চাকরিটা পাওয়ার আগে অবধি যারা সম্রাটকে পাত্তাই দিত না সেভাবে, এখন সেইসব পরজীবীগুলো সম্রাটকে আঁকড়ে ধরেছে। গাঁজা, মদ এসবের যোগানদার সম্রাট এদের ঈশ্বর হয়ে উঠেছে। আমি পাড়ার ভেতর না ঢুকে রাস্তাটা পার হয়ে এলোমেলো হাঁটতে লাগলাম। এক্ষুনি বাড়ি যেতে ইচ্ছে করছে না। তাছাড়া আজ তো একটু তাড়াতাড়ি ফিরেছি অফিস থেকে। অন্য সময় হলে ক্লাবে গিয়ে একটু ক্যারাম পিটিয়ে আসা যেত। কিন্তু ইদানীং আর ক্লাবে যাওয়া যায় না। গাঁজা-মদের দূরন্ত আসর জমে প্রতিদিন।
সম্রাটের সাথে আজ আর দেখা না হলেই বোধহয় ভালো হত। তাহলে কাল রাত্রের দুর্ঘটনার কথাটা জানতে পারতাম না। পরে আবার যখন দেখা হত তখন আমি হয়তো ব্যাপারটাকে সাধারণভাবেই নিতাম। কিন্তু আজ, যখন জানতে পারলাম কাল ওর বাইকে চড়লে মৃত্যু অনিবার্য ছিল, কেমন অদ্ভুত সব অনুভূতি হচ্ছে। প্রথম যখন শুনলাম একটা ঠাণ্ডা শিরশিরানি নেমে গেছিল মেরুদণ্ড দিয়ে। কিন্তু যত সময় যাচ্ছে অনুভূতিটা পাল্টে যাচ্ছে। এখন কেমন যেন একটা আফশোস হচ্ছে। এবং তত আমি অবাক হয়ে যাচ্ছি। আমি কি পালাবার কথা ভাবছি ?
খুব ছোটবেলার একটা ঘটনা মনে পড়ছে। আমি তখন ক্লাস থ্রি-ফোরে পড়ি। আমাদের কুয়োতে একটা বেড়াল পড়ে গিয়েছিল। কুয়োর ভিতরে গজিয়ে ওঠা গাছপালাকে আঁকড়ে ধরে বাঁচতে চাইছিল প্রাণপণে। বাবা বালতি নামিয়ে দিয়েছিল কুয়োর ভিতর। যাতে সেটাকে ধরে উঠে আসতে পারে বেড়ালটা। কিন্তু বেড়ালটা কিছুতেই বালতিটার ওপর উঠতে পারছিল না। যতবার চেষ্টা করছে, ততবার পিছলে যাচ্ছে। আর আমরা চমকে চমকে উঠছি। ভয়ে আমাদের বুক হিম হয়ে যাচ্ছিল। শেষমেশ বেড়ালটা সফল হল। কুয়ো থেকে বেরিয়ে এসে ঝুপ করে লাফ মারল মাটিতে। তারপর অনেকক্ষণ চুপ করে বসেছিল বেড়ালটা। বোধহয় ওর ক্ষুদ্র মস্তিষ্ক দিয়ে বুঝে নিচ্ছিল কী বিরাট ভাগ্য ওর। সেই থেকে দৃশ্যটা আমার মগজে গেঁথে গেছে। ‘মৃত্যু থেকে ফিরে আসা’ বলতে এই দৃশ্যটাই আমার মনে এসেছে এতকাল।
বেঁচে যাওয়ার পর বেড়ালটার যে অনুভূতি হয়েছিল তার একটাই নাম। সুখ। প্রবল সুখ। এবং এখানটাতেই আশ্চর্য ... আমার কোন অনুভূতি হচ্ছে না। যদিও আমার সরাসরি অভিজ্ঞতা হয়নি তবু ... । কেন বারবার মনে হচ্ছে, যদি কাল দাঁড়িয়ে যেতাম তারাতলায়। যদি অপেক্ষা করতাম সম্রাটের জন্যে। রাস্তার ধারে আমার পড়ে থাকা রক্তাক্ত মৃতদেহটার প্রতি হিংসে হচ্ছে। এবং একটু আগে মনে আসা কথাটার গা থেকে আমি একটু একটু করে প্রশ্ন চিহ্ন মুছে ফেলছি। না, কোনও সন্দেহ নেই, আমি পালাতে চাইছি। জীবনের কাছ থেকে, হয়তো বা নিজের কাছ থেকেও।
হ্যাঁ, তিয়াসা আমার মনের কথাটা জানতে পারলে আমাকে তীব্র ভর্ৎসনা করবে। সে একা একা একটা লড়াই চালাচ্ছে, তাও প্রত্যক্ষভাবে, আর আমি? এতদূর থেকে একটা পরোক্ষ যুদ্ধ করতে গিয়েই পালাবার কথা ভাবছি! ঠিকই। তবু চিন্তাটা বোধহয় অমূলক নয়। কাল যদি আমি মারা যেতাম তাহলে তিয়াসা ধ্বংসের মুখোমুখি হত একথা সত্যি। কিন্তু শেষমেশ হয়তো এতে ওর ভালোই হত। ওদের সবার। তিয়াসা, তিয়াসার বাবা, মা।
তিয়াসার বাবা কাল আমায় ফোন করেছিলেন। তাঁর অফিস থেকে। আমিও তখন অফিসে। সরাসরি বলেছিলেন, দেখো, লাভ ম্যারেজ তো কতই হচ্ছে। আমিও আপত্তি করতাম না। কিন্তু ... প্লিজ ডোন্ট মাইন্ড, তোমার চাকরিটা ...! তারপর ঠাণ্ডা, আরও ঠাণ্ডা হয়ে গেছিল তাঁর কণ্ঠস্বর, তোমাদের সম্পর্কটা তোমরা এখানেই শেষ করে দাও। আমি তিয়াসাকেও একথা বলেছি। তোমাকেও একথা জানিয়ে দিলাম। মার্চ মাসের গরমেও আমার কাঁপুনি দিয়ে শীত করছিল। তিয়াসার বাবার ধাতব শীতল কণ্ঠস্বর চকিতে যেন ফোন থেকে বেরিয়ে এসেছিল একটা ধারালো অস্ত্র হয়ে। আর আমার কণ্ঠনালিতে আলতো করে চাপ দিচ্ছিল। দু-এক ফোঁটা অদৃশ্য রক্ত গড়িয়ে এসে আমার শার্ট ভিজিয়ে দিয়েছিল। আমি প্রচণ্ড ঘামছিলাম।
তিয়াসা ফোন করেছিল সন্ধেবেলা। অফিস থেকে তখন ফিরছি। ওর কান্নাভেজা স্বর – আমি আর পারছি না গো। খুব দ্রুত আমাকে বোবা করে দিয়েছিল। তিয়াসা আরও অনেক কথা বলেছিল, ওর বাবার রাগের কথা। মায়ের কান্নার কথা। ওর অসহায়তার কথা। একাকিত্বের কথা, অস্থিরতার কথা। কিন্তু সেসব কথা না বললেও চলত। ‘আমি আর পারছি না গো’ তিয়াসার এই একটা কথাতেই আমি সমস্ত ব্যাপারটা বুঝতে পেরেছিলাম। কোনওদিন ওদের বাড়ি যাইনি। কিন্তু ঐ একটা কথাতেই আমি ওদের বাড়ির ভেতরটা দেখতে পেয়েছিলাম। তিয়াসার মায়ের শূন্য দৃষ্টি। গালে শুকনো কান্নার দাগ। ওর বাবার অনমনীয় মনোভাব ও অসহায় পায়চারি। একটু দূরে, হয়তো বা খাটের ছত্রি ধরে তিয়াসার নিশ্চুপ দাঁড়িয়ে থাকা।
আসলে তিয়াসার জন্মের মুহূর্ত থেকে এ বাড়ির এক ঘর থেকে অন্য ঘরে উড়ে বেড়িয়েছে একটা স্বপ্ন। একজন সুপ্রতিষ্ঠিত যোগ্য মানুষের স্বপ্ন। তিয়াসার সমস্ত দায়ভার থাকবে যার হাতে। ছোট্ট তিয়াসা একটু একটু করে বড় হয়েছে আর ধীরে ধীরে শাখা-প্রশাখা বিস্তার করেছে সেই স্বপ্ন। আজ যখন এ বাড়িতে শুধু স্বপ্নটাই এক এবং একমাত্র স্বপ্ন, তখন হঠাৎ সেই স্বপ্নের ডানা মুচড়ে গেছে। আহত পাখির মতন তার লুটিয়ে পড়া ছায়া এ বাড়ির সব আলোকে যেন মুহূর্ত ঢেকে দিয়েছে।
রাত বাড়ছে। আমাদের এদিকটা সদ্য কলকাতা পিনকোড জোগাড় করেছে ঠিকানায়। কিন্তু আসলে এখনও মফস্বলই রয়ে গেছে। রাত দশটার পরই রাস্তাঘাটে লোকজনের চলাচল অপেক্ষাকৃত কম। হ্যালোজেনের ঘোলাটে আলোর ভিতর হাঁটছি। চূড়ান্ত বিষণ্ণ একটা রাত আমার চারিদিকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে।
আরো বেশ কিছুক্ষণ হাঁটবার পর আমার কেমন লজ্জা করতে লাগল, ছিঃ! তিয়াসাকে কি আমি অন্য কারও হাতে তুলে দেওয়ার কথা ভাবছি। তিয়াসা, যে মেয়েটা তার বাড়ির বিরুদ্ধে লড়াই করে চলেছে, তীব্র লড়াই – আমার সামান্য চাকরির সামান্য বেঁচে থাকার সাথে যুক্ত হতে চাইছে, অন্তত অর্থনৈতিকভাবে ভালো থাকার সম্ভাবনাগুলোকে অগ্রাহ্য করে – আমি তাকে ছাড়তে চাইছি! তাকে!
না, না। নিশ্চয়ই আমি তা চাইছি না। শুধু ভাবছি, মৃত্যু যদি কাল সরিয়ে দিত আমায়, তাহলে কী হত! আসলে কাল তিয়াসার ফোনটার পর থেকে একটাই চিন্তা মাথায় ঘুরছে আমার। আমার জন্য, শুধু আমার জন্য কতগুলো মানুষ কষ্ট পাচ্ছে। হয়তো তাই মৃত্যু আমাকে একটা সুযোগ দিচ্ছিল।
স্পষ্ট দেখতে পেলাম আমাকে ফোন করছে, সম্রাট নয়, কালো চাদর পরিহিত একটা ভয়ঙ্কর কঙ্কাল! মৃত্যু! বারবার অনুরোধ করছে দাঁড়িয়ে থাকতে। সে আসবে... ।
বাড়ি ফেরার পথে শুনতে পেলাম কেউ একজন ক্লাবের সামনে বসে জোরে জোরে গাইছে। গলা শুনেই চিনতে পারলাম, প্যাঙ্কা। আমাকে দেখেই ডাকল, ‘অ্যাই তন্ময়, শুনে যা’। প্যাঙ্কাকে আমি আজকাল মানুষ তো দূরের কথা প্রাণী বলেও ভাবিনা। ক’দিন আগে পাড়ারই একটি মেয়ের স্নান করার দৃশ্য লুকিয়ে দেখতে গিয়ে বেধড়ক মার খেয়ে শয্যাশায়ী হয়ে পড়েছিল। এখন একটু সেরে উঠেই আকণ্ঠ মদ গিলে বসে আছে। আমি চলেই যাচ্ছিলাম, হঠাৎ শুনলাম সম্রাটের গলা, অ্যাই তন্ময়, শোন না।
গিয়ে দেখি ক্লাবের সামনে অন্ধকারের ভিতর আরও অন্ধকার হয়ে বসে আছে প্যাঙ্কা আর সম্রাট। সম্রাট ছোট্ট একটা কাঁচি দিয়ে গাঁজার পাতা কাটছে যত্ন সহকারে। বলল, কী হয়েছে তোর?
--- কী হবে।
--- মালের সাথে বাওয়াল হয়েছে? দ্যাখ একটু আগেই যখন দেখা হল সন্দেহ হচ্ছিল। আর এখন তোর হেঁটে যাওয়া দেখে আই অ্যাম সিওর, কুছ তো হুয়া হ্যায়।
--- আমি বাড়ি যাচ্ছি।
--- আরে দাঁড়া না। একটু বসে যা, জানিস প্যাঙ্কা, তন্ময়ের গার্লফ্রেন্ডটাকে হেভী দেখতে। আমি দেখেছি।
তাই শুনে প্যাঙ্কা খ্যাঁক খ্যাঁক করে হাসতে হাসতে বলল, ‘আরে বাওয়া, লাইন মারলে ওর’ম একটু আধটু...’
প্যাঙ্কা এই পর্যন্ত অসংখ্য প্রোপোজ করেছে। বলা বাহুল্য কেউই পাত্তা দেয়নি। প্যাঙ্কারা ভাড়া বাড়িতে থাকে, প্যাঙ্কা গোডাউনে কাজ করে, ওর চেহেরা কালো, শীর্ণকায়, পাড়ায় ভীষণ বদনাম – নাকচ করার অনেক যুক্তি মেয়েগুলি দেখিয়েছে। শেষমেশ প্যাঙ্কা মেয়েদের বাথরুমে উঁকি মারা শুরু করেছে।
সম্রাটের সমস্যা অন্য। সে হ্যান্ডসাম, স্মার্ট। মেয়েদের অভাব তার কোনোদিনই হয়নি। কিন্তু সেই যে কলেজের ফার্স্ট ইয়ারে সুপর্ণা নামের মেয়েটা ওকে প্রত্যাখ্যান করেছিল আজ পর্যন্ত ও সেই আঘাতটা সামলাতে পারেনি। ফুর্তির প্রয়োজনীয়তা ছাড়া মেয়েদের সঙ্গে মিশবার মতন কারণ সে খুঁজে পায় না তারপর থেকেই।
সম্রাট এবার বেশ সিরিয়াস ভঙ্গিতে বলল, ‘তন্ময়, এইসব ন্যাকাপনা ছাড়। নইলে শুধু শুধু কষ্ট পাবি। মেয়েরা শুধু ...’
সমাজের হিসাবে সম্রাট আর প্যাঙ্কা দু’জন ভিন্ন জগতের বাসিন্দা। কিন্তু একটা দিকে দুজনের ভীষণ মিল। ভালোবাসার ওপর থেকে বিশ্বাস হারিয়ে ফেলেছে ওরা। এও কি এক ধরনের মৃত্যু নয়! গাঁজার কটু গন্ধের ভিতর থেকে কি ওদের শবদাহের গন্ধই ভেসে আসছে না? বললাম, তোরা ভুল ভাবছিস। ভালোবাসা জীবনেই না’ই থাকতে পারে। কিন্তু ভালোবাসার ওপর বিশ্বাসটা হারিয়ে ফেলাটা আমার মতে...
--- দোর শালা জ্ঞান মারাচ্ছিস?
সম্রাট চেঁচিয়ে উঠল, খুব ভালোবাসা দেখাচ্ছিস না?
ঠিক এই সময় ফোন বেজে উঠল। তিয়াসা। কান্নাভেজা আবেগময় স্বরে বলল, কাল একবার দেখা করতে পারবে? লাইব্রেরী যাওয়ার নাম করে আসব। সাড়ে ন’টা নাগাদ। তোমায় দেখতে এত ইচ্ছে করছে...
কেন জানিনা চোখে জল চলে এল। বললাম, আসব।
--- তোমার অফিস...
--- সে ম্যানেজ করে নেব।
আমি এখন বাড়ির পথে। আকাশ দিয়ে একটা প্লেন যাচ্ছে। তিয়াসাদের বাড়ি এয়ারপোর্টের কাছাকাছি। ওদের বাড়ির খুব কাছ দিয়ে প্লেন যায়। এই প্লেনটার কি এখন ওদের বাড়ির খুব কাছ দিয়ে যাচ্ছে? প্লেনটার দিকে দেখতে দেখতে বললাম, আমাকে ক্ষমা করে দিও তিয়াসা। আমি স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি তোমায়। তুমি ছাদে, জানালায় অথবা ব্যালকনিতে। আমাকে খুঁজছ। আর আমি পালাবার কথা ভাবছিলাম! আমার নিজের উপর ঘেন্না হচ্ছে তিয়াসা। আমি এখন বুঝতে পারছি কাল আমাকে মৃত্যুর নাগাল থেকে আসলে দূরে সরিয়ে নিয়ে গিয়েছিল আমাদের ভিতরকার চার অক্ষরের এক অমোঘ সম্পর্ক। কী আশ্চর্য! আমি এতক্ষণ তাকেই অবহেলা করে চলেছিলাম সবচেয়ে বেশি। তবে কি বাস্তবের ঠোক্কর খেতে খেতে কোনও এক বিন্দুতে জন্ম নিচ্ছিল সংশয়! মারণরোগের মতন যা এক বিন্দু থেকে অন্য বিন্দু হয়ে ছড়িয়ে পড়তে পারত সর্বত্র। প্যাঙ্কার মতো, সম্রাটের মতো তবে কি আমিও বিশ্বাস হারিয়ে ফেলেছিলাম? আমিও কি মারা যাচ্ছিলাম ওদের মতো ... তিয়াসা? আমি ... আমি কেন ভুলে যাচ্ছিলাম বেঁচে থাকার সেই বীজমন্ত্রের কথা ... ভালোবাসা ... ওঃ তিয়াসা! আমি আবার বেঁচে উঠছি ... এই দ্যাখো ...
                                                                                                                                     HOME

এই লেখাটা শেয়ার করুন