ছোটগল্প

ঈশানকোণ একটি সাহিত্যের ওয়েবজিন গ্রীষ্ম সংখ্যা মে ২০১৭ ইং 

[ঈশানকোণ নতুন সংখ্যা দেখার জন্যে এখানে ক্লিক করুন]

একবার এসেছিলো নীরবে
নীহার চক্রবর্তী

ভাদুরিবাড়ির ছোট ছেলে রাজন গলায় দড়ি দিয়ে আত্মহত্যা করলো। চারদিকে সাড়া পড়ে গেলো খুব। ও বাড়িতে কেউ আত্মহত্যা করতে পারে কেউ ভাবতে পারেনি। উচ্চশিক্ষিত বাড়ি। অর্থের কোন মা-বাপ নেই সেখানে। দেখে তো মনে হয় সবাই খুব সুখে-স্বাচ্ছন্দ্যে আছে। তাহলে? কারণ কী? কারণ খোঁজা চলতে থাকলো।

দুদিনের মধ্যেই কারণ জানা গেলো। রাজন প্রেমে পড়েছিলো বাড়ির কাজের মেয়ে বিশাখার। ওকে ঘরে তুলতে চেয়েছিল বৌ হিসাবে। সে বিধবা যুবতী। মায়ের মৃত্যুর পর সে ভাদুরিবাড়িতে কাজে যোগ দেয় বছর পাঁচেক আগে। বিশাখার গোপন চোখের জল বুঝি উপলব্ধি করতে পেরেছিল রাজন। তাই বিশাখাকে গোপনে কথা দিয়েছিলো ওর বৌ করবে বলে। সহবাসও হয় রীতিমতো গুপ্ত অভিসারে।

কিন্তু বিশাখার আর তর সইল না।
একদিন রাজনের কণ্ঠালগ্ন হয়ে বলল, “অনেক দেরী হয়ে গেছে গো। এবার আমাকে বৌ হিসাবে স্বীকার করে নাও। আমি তোমার সন্তানের মা হতে চাই।”
শুনে খুব ভ্রূ কোঁচকাল রাজন।
তারপর ওকে দূরে ঠেলে দিয়ে বেশ মেজাজের সঙ্গে বলে উঠলো, “আমি কি বলিনি তোমাকে? এত তাড়া কীসের? আমাকে সবদিক দেখতে হবে না? আর একথা বলবে না তুমি একদম।”
শুনে খুব অবাক হল বিশাখা।
অস্ফুটে বলল শুধু রাজনকে, “তোমার তো এখন একটাই দিক। আমি। তাই না?’’
তারপর বিশাখার দু’চোখ জুড়ে জল এলো। কালক্ষেপ না করে প্রমাদ গুনতে গুনতে গুপ্ত অবস্থান থেকে বেরিয়ে গেলো। আনমনে হাঁটতে শুরু করলো যেদিকে চোখ যায় ।

সরাসরি বিশাখা গেলো স্থানীয় থানায়। কেঁদে-কেঁদে সব জানালো থানার বড়বাবুকে। সে শুনে থ। তার মনে হল তখন, এ কেমন রুচি ভাদুরিবাড়ির ছেলের? ভাবা যায় না। কিন্তু তার চাউনির মধ্যে বিশাখা খুঁজে পেলো না কোন দিশা।
সে বুঝেও বলে বসলো কান্না-ভেজায় গলায় তাকে, “আমি কাজের মেয়ে বলে আমি মানুষ না, আমার মধ্যে প্রেম নেই, এমন কথা কখনো ভাববেন না। মানুষের আবার ভেদাভেদ কীসের? অর্থ আর শিক্ষা দিয়ে বুঝি…’’
বিশাখার কথাগুলো বেশ বুকে লাগলো বড়বাবুর তখন।
সে লজ্জিত হয়ে বলল, “আমি সব দেখছি, মা। তুমি চিন্তা কর না। আমি নিজে গিয়ে তোমাকে বৌ করে ওই বাড়িতে তুলে আসবো। দম্ভ ওদের চুরচুর হবে। হতেই হবে।”

তারপর মনে আশার আলো নিয়ে বিশাখা নিজের ঘরে ফিরে এলো। ঘর বলতে ওর চার বছরের একটা ছেলে আর বৃদ্ধ বাবা। বিশাখা কাউকে কিছু না বলে চুপ করে থাকলো। ওর মধ্যে অস্থিরতাও কম দেখা গেলো না। নিজের কপালের জন্য খুব চোখের জল ঝরাল গোপনে। ভাদুরিবাড়িতে কাজে যাওয়া বন্ধ করে দিলো ও। শুধু দেখা ছাড়া ওর তখন উপায় ছিল না।

তারপরেই একদিন বিকালের দিকে রাজন গলায় দড়ি দিলো দোতলার ঘরে সিলিং-ফ্যানে। পরে জানা গেলো, স্বয়ং বড়বাবু এসে ওকে সহ বাড়ির সবাইকে খুব ভয় দেখায়। শিগগির বিশাখাকে রাজনের বৌ করে ঘরে তূলতে বলে। সবাই হতবাক। রাজনের মা কেঁদে আকুল। বাবা শুনে বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়ে সাথে-সাথে। রাজনের দুই দাদা আর দুই বৌদি লজ্জায় মুখ ঢাকে।
কথাও দিয়ে বসে বড়বাবুকে রাজনের বড়দা রঞ্জন, “আমরা দেখছি। সব ব্যবস্থা করছি।”
বড়বাবু এক সপ্তাহের সময় দিয়ে তারপর চলে যায়।

চারদিকে যখন ছি-ছিক্কার পড়ে গেলো, তখন একদিন সকালের দিকে বিশাখা আবার রাজনদের পাড়ায় এলো। ওকে দেখে অনেকেই ছুটে এলো। ঘিরে ধরতে চাইলো ওকে। কিন্তু বিশাখা না দাঁড়িয়ে ভাদুরিবাড়ির মধ্যে ঢুকে গিয়ে উঠোনে দাঁড়িয়ে কান্না শুরু করলো হাউহাউ করে।
কাঁদতে কাঁদতে বলতে থাকলো, “এ কেমন সমাজ আমাদের? সাহসী হতে গিয়েও সাহস হারায় তার জন্য। এ কেমন প্রেম? কেন এ সমাজ মানে না উঁচু-নিচুর প্রেম? বলতে পারেন কেউ? আমি কি রাজনবাবুকে মেরেছি? সমাজ মেরেছে। সমাজের মানুষ মেরেছে ওকে। আমাকে ক্ষমা করুন আপনারা আমাকে।”
বিশাখাকে দেখে ছুটে এলো রাজনের বড়দা রঞ্জন।
সে ওর দু’হাত চেপে ধরে চোখের জল ফেলতে ফেলতে বলল, “চুপ কর, বোন। খুব সত্যি কথা বলেছিস তুই। রাজন বাড়িতে বললে বুঝি আমরা মানতাম না। রাজন মরেছে নিজের ব্যর্থতায়। তোর প্রতি ঘৃণায় নয়। পুলিশের ভয়েও নয়। আমরা এবার তোর ঘরের ব্যবস্থা করছি আমাদের আত্মীয়দের মধ্যে থেকেই। আর কাঁদিস না। তোর চোখের জলের ফোঁটাগুলো এক-একটা লজ্জা আমাদের জন্য।”
বিশাখার মুখে তখন ম্লান হাসি ফুটল। চোখের জল মুছে নিলো কাপড়ের আঁচলে।
তারপর রাজনের মা, দাদা-বৌদির উদ্দেশ্যে বলল কষ্টের এক চিলতে হেসে, “এবার ঘর করলে আমি দুশ্চরিত্রা হব। বিশ্বাস করুন আমাকে। আমি এ বাড়ির মেয়ে হয়ে বাকি জীবন কাটিয়ে দিতে চাই। শুধু রাজনবাবুর স্মৃতি থাক আমার বুক-জুড়ে।”

সেইথেকে বিশাখা আবার কাজ করছে ভাদুরিবাড়িতে। এখন ও একদম বাড়ির মেয়ের মতো। কিন্তু এদিকে রাজনের জন্য চোখের জল একে-একে প্রায় সবার শুকিয়ে গেলেও বিশাখার চোখের জল শুকায়নি। কাজের একটু অবসরে বিশাখা চোখের জল ফেলতে শুরু করে। চোখের জলের বাঁধ মানে না ওর। তখন বাড়ির যেই ওকে দেখে, সে কান্নার কারণ জিজ্ঞেস করে। বিশাখা তখন খুব কষ্টে সারামুখে হাসি এনে চোখের জল শুকিয়ে দেয় নিমেষে।
                                                                                                                                     HOME

এই লেখাটা শেয়ার করুন