ছোটগল্প

ঈশানকোণ একটি সাহিত্যের ওয়েবজিন গ্রীষ্ম সংখ্যা মে ২০১৭ ইং 

[ঈশানকোণ নতুন সংখ্যা দেখার জন্যে এখানে ক্লিক করুন]

সরীসৃপ
সদানন্দ সিংহ

এক
দুটো সাপ ফণা তুলে দাঁড়িয়ে। সামনে আমি। আই বাপ, সাপেরা কি অত উঁচুতে মাথা তোলে! কাটা জিভ দুটো হি-স-স করে বের হয়েই ঢুকে যাচ্ছে। হি-স-স করে যেন বাতাস কাটছে, মুখ শুকিয়ে গেলে যেমন হয়। যেমন আমার।
আসলে আমি সাপ-টাপ একদম ভয়ই পাইনা। এইসব কাটা জিভে আমার ভয় করেনা। কতোবার আমার পায়ের ওপর দিয়ে সাপেরা চলে গেছে। এবড়োখেবড়ো চিহ্ন রেখে। আমার কিছুই হয়নি। ঐ যে, আমার ভয় করেনা। আর ভয় করে কোন্‌ শালারই বা লাভ?
আরো মাথা তুলে দাঁড়ায় সাপ দুটো। হি-স-স করে জিভ বের করে। সত্যি বলতে গেলে সাপ-টাপগুলোও আমাকে কিছুই করেনা। হয়তো সাহসই পায়না। কতোখানেই কতো সাপের সঙ্গে আমার দেখা হয়ে যায়। ফ্যাল্‌ ফ্যাল্‌ করে ওরা আমার দিকে চেয়ে থাকে। আর ফণা তোলে। তারপর সুড়সুড় করে একসময় চলে যায়। এরকমই হয়। আজও হলো। মাথা নামিয়ে সাপ দুটো সুড়সুড় করে চলে যেতে থাকে। নরম ঘাসমাটির ওপর দিয়ে। যেতে যেতে বাগানের দুটো সান ফ্লাওয়ার গাছে শরীরটাকে বেশ করে প্যাঁচায়। তারপর নেই কোন নড়নচড়ন। দুটো সাপেরই একই ভূমিকা। বাস্তুসাপ হবার সপ্ন দেখছে নাকি রে। হেই হেইয়ো। আমার হাতের দুটো ঢিল এসে সান ফ্লাওয়ার গাছের গায়ে লাগে। সাপ দুটো এবার মাটিতে। মুহূর্তের মধ্যেই সাপ দুটো ফণা তুলে দাঁড়ায় অনেক অনেক উঁচুতে। তারপর সাপ দুটো হঠাৎ ফণা নামিয়ে একসঙ্গে দুটো বৃত্ত রচনা করতে থাকে। দুটো সাপই মুখ দিয়ে নিজের লেজটাকে কামড়ে ধরেছে। দুটো স্টীলের চাকা যেন তৈরি হয়ে যায়। শক্ত, খুবই শক্ত। তারপরই হঠাৎ ব্যাপারটা ঘটে। চোখের নিমেষে সাপ দুটো লাফ মেরে একেবারে কৃষ্ণচূড়া গাছের আগায়। অদ্ভূত ব্যাপার! হঠাৎ আবার সাপ দুটো শূন্যে ঝাঁপ দেয়। বাতাসে সাঁতার কাটতে কাটতে সাপ দুটো আবার নিচে নেমে আসে। আবার দুটো স্টীলের চাকা তৈরি হয়। তারপর লাফ মেরে অন্য আরেকটা গাছের মাথায় উঠে যায়। কিছুক্ষণের মধ্যেই আবার ভাসতে ভাসতে নিচে। আবার পুনরাবৃত্তি ঘটে। শুধু গাছগুলি পালটে যায়। এ যেন এক খেলা। আমি অবাক হয়ে দেখতে থাকি। তারপর আমি ছুটতে থাকি। এই অদ্ভূত ব্যাপারটি সবাইকে জানানো দরকার।

দুই
ছুটতে ছুটতে আমি একসময় একজন মাঝারি বয়স্ক লোককে হন্তদন্ত হয়ে সামনে হাঁটতে দেখি। আমি লোকটিকে ডাকতে থাকি, একটু শুনবেন? লোকটি শুনতেই পান না। আমি আবার ডাকি, শুনছেন, শুনছেন? আশ্চর্য লোকটি আমাকে একবার পেছন ফিরে দেখে আরো জোরে হেঁটে মিলিয়ে যান। আমি হাঁপাতে হাঁপাতে দাঁড়িয়ে পড়ি। দেখি, সামনেই একজন বৃদ্ধ লোক লাঠি নিয়ে হাঁটছেন। আমি এগিয়ে বৃদ্ধ লোকটির কাছে গিয়ে বলি, জানেন, দুটো সাপ---।
চোখ দুটি গোল করে দাঁড়িয়ে পড়েন বৃদ্ধ লোকটি, সা-প!
--- হ্যাঁ সাপ। উড়ন্ত সাপ।
--- উড়ন্ত সাপ?
--- হ্যাঁ হ্যাঁ, আমার পায়ের কাছ থেকে দুটো সাপ সু-ই-ই করে এক গাছের মাথায় উঠে গেল। বাতাসে ভাসতে ভাসতে আবার নেমে এল।
--- বেশ বেশ।
--- তারপর আবার উঠে গেল, আবার নেমে এল। আপনি দেখবেন সাপ দুটোকে? দেখবেন?
--- উহু, আমার একদম সময় নেই। এক কাজ করুন আপনি, এবার যদি সাপ দুটোকে হাতের কাছে পান, খপ করে সাপ দুটো ধরে ফেলবেন। তারপর বেঁচে দেবেন। ভালো দাম পাবেন। আচ্ছা চলি। বলে বৃদ্ধ লোকটি চলে যেতে থাকেন।
দুঃখ হয় আমার, ব্যাপারটা বিশ্বাস করলেন না বলে। এমন সময় ফিটফাট পোশাক পরা এক যুবককে দেখি এদিকেই আসছে। হাতে বেশ কয়েকটি কভার ফাইল। কাছে আসতেই আমি বলি, এক্সকিউজ মি, আপনার কি খুব তাড়া?
যুবকটি দাঁড়ায়, কেন বলুন তো?
আমি বলি, দুটো সাপ দেখবেন? উড়ন্ত সাপ। বাতাসে ভেসে ভেসে বেড়ায়।
তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে যুবকটি বলে, দুঃখিত স্যার, আমার একদম সময় নেই। চলে যায় যুবকটি। এবার আমি একা একা হাঁটতে থাকি। হাঁটতে হাঁটতে আমি এক বাসস্ট্যাণ্ডে একজন ভদ্রমহিলাকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখি। চোখে সানগ্লাস। শ্যামলা এবং বেশ সুন্দরী। আমি দাঁড়িয়ে পড়ি। আমার কিনার দিয়ে অসুস্থ মানুষেরা চলে যায়। আমি ভদ্রমহিলার দিকে তাকাচ্ছি। ভদ্রমহিলাও আমার দেকে তাকাচ্ছেন।

তিন
সামনে এগিয়ে আমি মৃদু হাসি। ভদ্রমহিলাও মৃদু হাসেন। আমি বলতে শুরু করি, জানেন, আজ আমার পায়ের কাছ থেকে দুটো সাপ লাফ মেরে গাছের উপরে উঠে গেল, তারপর ভাসতে ভাসতে নিচে নেমে এল। শুনে ভদ্রমহিলা উত্তর দেন, বাঃ, বেশ ইন্টারেস্টিং তো। আমি আবার বলতে থাকি, আপনি সাপ দুটোকে দেখবেন? ব্যাপারটা একটু অদ্ভুত তো, কেউ বিশ্বাস করতেই চাইছেনা। যাবেন আপনি আমার সঙ্গে? উড়ন্ত সাপ দুটোকে দেখবেন? যাবেন?
--- কী বলছেন, আপনার সঙ্গে যাবো?  
--- হ্যাঁ হ্যাঁ, আপনাকে দেখাতে চাই।
--- ঠিক আছে। যাবো। তবে দুহাজার টাকা দিতে হবে সেজন্য।
--- দুহাজার টাকা! কেনো?
--- আমার টাকার দরকার।
--- কেনো?
--- কেনোর জবাব দীর্ঘ, এ মুহূর্তে দেবার ইচ্ছেও নেই। বলুন দুহাজার দিতে পারেন কিনা। তাহলে যাবো।
--- কিন্তু আমার পকেটে এক হাজার টাকার মত আছে যে।
--- শুধু হাজার। ঠিক আছে, চলুন। আমাকে ত্রিশ মিনিটের মধ্যেই ছেড়ে দিতে হবে কিন্তু। কি, রাজি?
যে অদ্ভূত ব্যাপারটার আমি একমাত্র সাক্ষী, সেটাকে দেখার জন্যে অন্য কেউ রাজি না থাকায়, আমার রাজি না হয়ে কোনো উপায় নেই তাই ‘রাজি’ বলেই আমি ভদ্রমহিলাকে নিয়ে অকূলস্থলের দিকে ছুটতে থাকি। হাতে সময় মাত্র ত্রিশ মিনিট। জানিনা, সাপ দুটো এখন আগের জায়গায় আছে কিনা।
                                                                                                                                     HOME

এই লেখাটা শেয়ার করুন