নিবন্ধ

ঈশানকোণ একটি সাহিত্যের ওয়েবজিন হেমন্ত সংখ্যা নভেম্বর ২০১৬ ইং 


[ঈশানকোণ নতুন সংখ্যা দেখার জন্যে এখানে ক্লিক করুন]
ত্রিপুরার লোককাহিনিঃ মৌখিক প্রত্নকথার বিশ্বজনীন রূপ
অশোকানন্দ রায়বর্ধন

(দুই)
বিভিন্ন জনজাতি বা ট্রাইবদের মতো ত্রিপুরী জনগোষ্ঠীর মধ্যেও এরকম মিথ প্রচলিত আছে। ত্রিপুরা রাজ্যে রাইমা ও শরমা নামে দুটি ক্ষীণতোয়া ছিল যা বর্তমানে ডুম্বুর জলাধারের গর্ভে চলে গেছে। এই দুটি ছড়ার উৎপত্তি সম্বন্ধে ত্রিপুরী জাতি লোকদের মধ্যে একটা মিথ প্রচলিত আছে। কাহিনিটি উল্লেখ করা যেতে পারে।
এক অচাইর (ত্রিপুরী ওঝা বা পুরোহিত) দুটো মেয়ে ছিল। তারা ছিল মাতৃহীন। সে কারণে তাদের রোজই বাবার সঙ্গে জুম খেতে কাজ করতে হত। ত্রিপুরীরা জুমখেতে টঙ্গঘর তৈরি করে বাসা বেঁধে জুম পাহারা দেয়। তাদের কোন টংঘর না থাকায় তারা ঝড়বাদলে কষ্ট পেত। তাদের বাবাকে বারবার বলেও তারা নিরাশ হয়। একসময় বড়ো বোন বনকুমারীর (বনদেবী) স্মরণাপন্ন হয়ে দেবীকে জানায় যে, যে তাদের জন্যে টংঘর তৈরি করবে, সে তাকে বিয়ে করবে। বনদেবী তার কথা শুনে একজন বনদেবতাকে পাঠালো। বনদেবতা রাতারাতি একটা টংঘর তৈরি করে দিয়ে একটা অজগর সাপের রূপ ধারণ করে টংঘরের মধ্যে বসে রইল। পরদিন সকালবেলা দু বোন জুমে এসে টংঘর দেখে খুশি হল। তারা টংঘরে ঢুকে একটা অজগর দেখতে পেল। বড়ো মেয়ে তার প্রতিজ্ঞামতো অজগরটিকে বিয়ে করল। কিন্তু তাদের বাপ অচাই বিষয়টিকে ভালভাবে নিল না। বড়ো মেয়ে যখন জুমে কাজ করতে গেল, তখন বাবা অজগরটিকে কেটে রান্না করল। মেয়েরা ফিরে এলে রান্না করা অজগরের মাংস খেতে দিল। বড়ো মেয়ে বুঝতে পারল ঘটনাটি। সে মনের দুঃখে যে পাহাড়ি ছড়াতে সাপের রক্ত ফেলা হয়েছিল সেখানে ঝাঁপ দেয়। দিদির শোকে কিছুদিনের মধ্যে ছোটো বোনও মারা যায়। বড়ো মেয়ে ছড়ার যে অংশে আত্মবিসর্জন করে, সেখান থেকে শরমা এবং ছোটো মেয়ের আত্মবিসর্জনের কেন্দ্রস্থল থেকে রাইমা ছড়ার উৎপত্তি। দু মেয়ে পরপর মারা যাওয়ায় এবং অনুশোচনায় তাদের বাবা অচাই পাহাড়ের উপর গিয়ে গুমরে গুমরে কাঁদতে থাকে এবং অঝোরে অশ্রু বিসর্জন করতে থাকে। তাদের বাবাই হল ডুম্বূর জলপ্রপাত।
ত্রিপুরীদের ভূমিকম্প সম্বন্ধেও একটি প্রচলিত মিথ আছে। মাটির নিচে এক বিরাট কচ্ছপ গোটা পৃথিবীকে ধারণ করে রাখে। তারই আহার্য যোগাড় করে দেয় প্রতিদিন খেবুম বা গুবরেপোকা । পৃথিবীর উপরের বিভিন্ন প্রাণীর মল সংগ্রহ করে সে বয়ে নিয়ে যায় কচ্ছপটির জন্যে। একাজ করতে করতে তার মধ্যে আলসেমির ভাব আসে। সে একদিন কচ্ছপকে গিয়ে বলে যে, পৃথিবীর সব প্রাণী মরে গেছে। কাজেই তার আহার্য মল নেই। কচ্ছপের খেবুম-এর কথা বিশ্বাস হয় না। সে তার শরীরটাকে নাড়া দেয়। পৃথিবীটা কেঁপে ওঠে। কচ্ছপ আসল সত্য জানতে পারে। গুবরেপোকা তাকে ফাঁকি দেওয়ার চেষ্টা করলেই সে গা নাড়া দেয় এবং পৃথিবীতে ভূমিকম্প হয়।
ত্রিপুরীদের গৃহদেবতা নকছুমতাই-এর পূজার প্রচলন এবং ত্রিপুরা নামের উৎস বিষয়কও একটি মিথ প্রচলিত আছে। লোককথাটিতে দেখা যায় –
কুফুরতি নামে মাতুলালয়ে পালিতা এক কন্যা ছিল। যৌবন সমাগমে সে চন্দ্রদেবের সঙ্গে গোপন মিলনে সন্তানসম্ভবা হয়ে পড়ে। গাঁয়ের লোক তার কথা বিশ্বাস করল না, তারা তাকে গ্রাম থেকে বের করে দিল। সেও গ্রামের বাইরে গিয়ে জুমের টংঘরে বাস করতে লাগল এবং সেখানে একটি ব্যাং সন্তানের জন্ম দিল। কিন্তু কুফুরতি তার নাম রাখল চন্দ্রকুমার। বড় হলে চন্দ্রকুমারের সঙ্গে তার বাবা চন্দ্রকুমারের সঙ্গেভ সাক্ষাৎ হয়। সে কিভাবে মানুষ হতে পারবে তার সন্ধান জানতে চায়। চন্দ্রদেব জানান, যদি কোন মেয়ে তাকে ভালোবেসে বিয়ে করে এবং ব্যাং-এর খোলসটি পুড়িয়ে ফেলে তাহলে সে মানুষ হতে পারবে। তখন চন্দ্রকুমার তার বাবার কাছ থেকে একটি ঘোড়া ও রাজপুত্রের পোশাক চেয়ে নিয়ে বেরিয়ে পড়ে। দূরদেশে এক রাজকন্যার সঙ্গে তার প্রণয়সূত্রে বিবাহ হয়। সে রাজকন্যাকে তার ব্যাং-এর পোশাক পুড়িয়ে ফেলতে বলে। রাজকন্যা পোশাকটি অর্থাৎ ব্যাং-এর খোলসটি পুড়িয়ে ফেলতে গেলে সেটি কথা বলে ওঠে, আমি তোমাদের ‘নকছুমতাই’। তোমরা আমার পূজোর ব্যবস্থা করো। তোমাদের আর কোন অমঙ্গল হবেনা। এই বলে নকছুমতাই অন্তর্হিত হন। রাজকন্যা আবরণটি পুড়িয়ে ফেলায় চন্দ্রকুমার মানুষরূপ ধারণ করে। রাজকন্যা নকছুমতাই-এর পূজোর প্রচলন করে। নকছুমতাই-এর আশীর্বাদে চন্দ্রকুমারের তিন পুত্র জন্মগ্রহণ করে। তারা তিনটি দেশ জয় করে রাজ্যপাট স্থাপন করে। রাজ্যের নাম হয় ত্রিপুত্রা। সেই ত্রিপুত্রা থেকেই ত্রিপুরা নামের উদ্ভব।
মিথ-এর মধ্যে কোনও একটি জাতিসত্তার লোক ইতিহাস, লোকবিশ্বাস ইত্যাদি নিহিত থাকে। ফলে এক-একটি জাতির মিথ-এর মধ্যে তার স্বকীয়তা বিদ্যমান থাকে। লোককাহিনিতে মিথ তাই একটি বিশেষ জনগোষ্ঠীর নিজস্ব সম্পদ। ত্রিপুরী জনগোষ্ঠীরও এই জাতীয় প্রচুর মিথ চালু আছে।
এছাড়া ত্রিপুরী লোককথার নিজস্বতা প্রমাণের জন্য যে সমস্ত লোকজ অনুষঙ্গের প্রতি দৃষ্টি দিতে হয়, সেগুলি লক্ষণীয়। এসব গল্পে আদিম মানুষের আগুন, কৃষির আবিষ্কার, সমাজ গঠন, শিশ্নের সৃষ্টি, ধর্মের উদ্ভব, ভাষা ব্যবহার শুরুর কথা, বিভিন্ন ধরণের খাদ্যাভ্যাস ইত্যাদির আভাস পাওয়া যায়। গবেষক সংগ্রাহক কুমুদ কুণ্ড চৌধুরী তাঁর সংগৃহীত লোককাহিনির ( কেরেঙ কথমা --- অক্ষর প্রকাশনী, আগরতলা) প্রায় প্রতিটিতে ত্রিপুরার জুমভিত্তিক কৃষিজীবনের ( বাতাস মামা, কলম্পাকন্যা, ভাইবোন হাতি হয়ে গেল, বাঘ ও শিয়ালের গল্প, নুয়াই রাজা, খুমবারতি, ছেলেরছা ) চিত্র পাওয়া যায়। এছাড়া বনের বাঁশবেতের দ্রব্য তৈরির লোকশিল্পের নিদর্শনও আছে (খুমবারতি), বাঁশ বিক্রি করে জীবিকা নির্বাহের (বিগ্রাছা) আছে, পশু শিকার জীবনেরও উল্লেখ পাওয়া যায় (সোনার পাখি), নদীতে বিষলতার জল মিশিয়ে দিয়ে ( দক্ষিণ ত্রিপুরায় এ ধরণের পদ্ধতিকে ‘ম্যাল’ দেওয়া বলে, যা এখনও উপজাতিদের মধ্যে চালু আছে) বিষ জর্জরিত মৎস শিকারের (ছেলেরছা) ব্যতিক্রমী কৌশলের বর্ণনা ত্রিপুরী লোককথাগুলির নিজস্বতার দাবী রাখে। জুমে উৎপন্ন বিভিন্ন কৃষিজ ফসলের মধ্যে তরমুজ, ফুটি, বাঙ্গি, জুমের তুলো, বিন্নি চাল, লাউ কুমড়া ইত্যাদি এবং খাদ্যাভাসের মধ্যে ভাত-মাংস, গোদক, বাঁশ করুল (বাঁশের অঙ্কুর), মদ্যপান ও তার সঙ্গে ‘চাখিনি’ (চাট)-এর ব্যবহার, পোশাক-আশাকের মধ্যে উপজাতীয় তাঁতে বোনা ‘রিছা’ (বক্ষবন্ধনী), ‘রিগনাই’ (ঊপজাতীয় মেয়েদের পরনের পাছড়া), ‘রিত্রাক’ (গায়ের বা বিছানার চাদর) এবং সেগুলিতে শিউলি ফুল, হাতির চোখ, মাছির ডানার লোক-নকশা তোলা ইত্যাদি একান্তই ত্রিপুরীদের নিজস্ব বিষয়। অসুখে-বিসুখে ও পূজা অনুষ্ঠানে মুরগি ডিম মদ্য ইত্যাদি দিয়ে ‘অচাই’-এর মাধ্যমে পূজো দেওয়া ইত্যাদি ত্রিপুরী জীবনী পদ্ধতির নিদর্শন। ডাইনি বা পরির অস্তিত্বে বিশ্বাস ইত্যাদি আদিবাসী সমাজের প্রাচীন জীননযাত্রার চিত্র লোককথাগুলোয় যত্র-তত্রই পাওয়া যায়। বাঘ, হাতি, অজগর, বানর, শেয়াল, কুমির পাখি, বিড়াল, মাছ, ব্যাঙ, সাপ ইত্যাদি বিভিন্ন স্থলচর, জলচর ও খেচর প্রাণীর উপস্থিতি ও তার সঙ্গে আদিবাসী জনজীবনের একাত্মতা ইত্যাদির উদাহরণও যথেষ্ট আছে। ত্রিপুরী আদিবাসী সমাজের সহৃদয়তা, সরলতা, আতিথেয়তা ইত্যাদি মানবিক গুণেরও অবস্থান লোককথাগুলোতে লক্ষ করা যায়। সামাজিক দুর্বলতার সুযোগে রাজন্য শক্তির পরাক্রম ও ছলচাতুরির চিত্রও (খুমবারতি, ছেলেরছা) সামাজিক অবস্থানকে স্পষ্ট করে দেয়।
বাংলা রূপকথার যেমন প্রতিটি রূপকথা শেষ হলে ‘আমার কথাটি ফুরোলো/নটেগাছটি মুড়োলো’ নামের ছড়াটি আওড়ানো হত বলে কথিত আছে, তেমনি ত্রিপুরা লোককাহিনির কিছু সমাপ্তি-সূত্র আছে। সংগ্রাহক-গবেষক শ্রী কুন্ড চৌধুরী তাঁর সংগ্রহ গ্রন্থের ভূমিকায় উল্লেখ করেছেন --- ‘প্রতিটি রূপকথা বলার শেষে ত্রিপুরী রূপকথার কথকরা দুটি কথা বলে থাকেন। এক, আওয়া তককে। এই কথার অর্থ সম্ভবত ‘এখানেই শেষ হল’। দ্বিতীয় কথা হল – দুখু থাও / সুখু ফাই / হা ছুছুক খুমপালি / নখা চুচুক মাইরুম ফাই’। কথাগুলোর প্রথম দুলাইনের অর্থ ‘দুঃখ যাক, সুখ আসুক। কিন্তু পরবর্তী লাইনগুলির অর্থ খুব পরিষ্কার নয় (কেরেঙ কথমা --- কুমুদ কুণ্ড চৌধুরী, অক্ষর প্রকাশনী আগরতলা) এক হিসেবে এই ছড়ার মধ্যেও একটা নিজস্বতা আছে।
কোন কোনও লোককাহিনি তার নিজস্ব বৈশিষ্ট্য নিয়ে ত্রিপুরী লোককথায় স্থান করে নিয়েছে। এখানে একটা বিষয় লক্ষ করা গেছে যে, যেসব গল্পে পশু-পাখির উপস্থিতি আছে, সে সকল গল্পের মধ্যে একটা নীতিকথা বিদ্যমান থাকে। পশুর মাধ্যমে লোকচরিত্রের উদঘাটন করা হয়। পশু বা পাখি কখনও কখনও অত্যাচারীর সাজা দিয়ে থাকে। আশ্রয়প্রার্থীকে আশ্রয়দানের করার মত মানবিক গুণসম্পন্ন হয়। এধরণের একটি ত্রিপুরী লোককথা হল ইঁদুর সর্দার। সর্দার ইঁদুর বিভিন্ন পতঙ্গ, সরীসৃপ এবং পক্ষীসমাজ থেকে উচ্চিংড়ে বউ, গিরগিটি বউ, ঘুঘু বউ ও দাঁড়কাক বউ নিয়ে সংসার করে। কিন্তু দাঁড়কাক বউয়ের সঙ্গে অন্যান্য সতীনদের বনিবনা না হওয়ায় ইঁদুর সর্দারের অশান্তি দেখা দিল। বউদের উভয় তরফ থেকে অভিযোগ, পাল্টা-অভিযোগ চলতে লাগল। তার মনে হতে লাগল তার বউয়েরা তাকে ভালোবাসে না। সে পরীক্ষা করার জন্য বালিশের পাশে একটা বেতের ছড়ি রেখে মরার ভান করে পড়ে রইল। বউদের বড়ো, মেজ ও সেজ তাদের স্বামী মারা গেছে বলে পাশে কান্নাকাটি করতে লাগল। কিন্তু ইঁদুর সর্দার লক্ষ করল, ছোটো বউ আসছে না। সে মারা গেছে ভেবে কাকবউ এসে আনন্দে গান ধরল, গা, গারে, গাগারে গা / আগে ইঁদুরের মাথা খা। ইঁদুর সর্দার বুঝতে পেরেই তড়াক করে লাফিয়ে উঠে পাশের ছড়িটি দিয়ে এক আঘাতেই কাকবউকে শেষ করে ফেলল। কাহিনিটিতে ‘যঃ স্বভাবো হি যস্য স্যাৎ’ এই সংস্কৃতি নীতিবাক্যটি আছে। সর্দারের বউয়েরা গোত্রান্তর হয়েও তাদের স্বভাব পাল্টায় নি।
ত্রিপুরী জাতির আর একটি সংগৃহীত ‘নুয়াই রাজা’ একটি বহুল প্রচারিত লোককাহিনি। কাহিনিটির বর্ণনার মধ্যে একটি পারিবারিক বিচ্ছিন্নতার বেদনা লক্ষ করা যায়। অনেক উপজাতীয় রমণী এই কাহিনিটি একটি বিশেষ সুর করে শোকসংগীতের মত পরিবেশন করেন। এই গল্পে আছে, দুবোনের মধ্যে বড়ো বোন ছোটো বোনকে হিংসে করে। একদিন দোলনা খেলার ছলে বড়ো বোন ছোটো বোনকে জলে ফেলে দেয়। জলের ভেতর এক রাঘব বোয়াল ছোটো বোনকে খেয়ে ফেলে। বড়ো বোন বাড়িতে এসে মিথ্যে কথা বলে। তাদের মা ঘাটে কাপড় কাচতে গিয়ে বিষয়টি জানতে পারে। তখন বাড়ি থেকে স্বামীকে ডেকে নিয়ে গিয়ে মাছের পেট থেকে ছোটো বোনকে বের করে। বাবা বড়ো মেয়ের শাস্তিস্বরূপ বিরাট খাঁচা বানিয়ে তাতে বড়ো মেয়েকে আটকে রাখে। তার প্রতি চলতে থাকে চরম অবহেলা। একদিন সে ছোটো বোনের কাছ থেকে বাঁশের ছিলা নিয়ে তা দিয়ে খাঁচা থেকে মুক্ত হয়। বনে গিয়ে নুয়াই পাখির রাজার কাছ থেকে ডানা চেয়ে নেয়। বাড়িতে এসে সে ডানাগুলো সেলাই করে পিঠে বেঁধে নেয় এবং একসময় আকাশে উড়ে চলে যায়। মা অনেক কান্নাকাটি করে তাকে ফেরাতে চায়, কিন্তু পারে না। সে নুয়াই রাজার কাছে পৌঁছোলে নুয়াই রাজা তাকে বিয়ে করে। আবার নতুন বছরে মেয়ে তার বর নুয়াই রাজাকে নিয়ে বাপের বাড়ি বেড়াতে আসে। রাত্রে সবাই ঘুমালে গলার লাল রঙের ঝুলিতে লুকিয়ে রাখা বিষধর ভীমরুল ছেড়ে দিয়ে মা-বাবাকে শাস্তি দেয়। এই লোককাহিনিটিতে খারাপ কাজের একটি যন্ত্রণাদায়ক দিক রয়েছে। আর নিজস্বতার প্রসঙ্গে সামগ্রিক কাহিনিটি ত্রিপুরার একটি প্রাকৃতিক বিষয় প্রাচীন লোক কথাকারের দৃষ্টি এড়ায়নি, তার নিদর্শন মেলে। এখানে শীতের শুরুতে যে পরিযায়ী পাখিরা সুদূর সাইবেরিয়া থেকে ত্রিপুরায় আসে, তাদের গলার লাল থলেটার কথা প্রচ্ছন্নভাবে ইঙ্গিত করা হয়ে থাকতে পারে নুয়াই পাখির বর্ণনায়। প্রতি বৎসরই এসব পাখিরা এসে কিছুদিন স্থানীয় খাল-বিল জলায় বসবাসের পর আবার অজানার উদ্দেশ্যে পাড়ি দেয়। সুন্দর দেখতে এই পাখিদের নিয়ে ত্রিপুরার লোককাহিনি, তার নিজস্ব সম্পদ।
লোককথার একটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য হল তার পরিযায়ী ক্ষমতা। স্থান থেকে স্থানান্তরে পরিচলনশীল মানব গোষ্ঠীর মতো লোককথাও এক স্থান থেকে অন্য স্থানে, এক ভূখণ্ড থেকে অন্য ভূখণ্ডে, এক গোলার্ধ থেকে অন্য গোলার্ধে পরিভ্রমণ করে থাকে। লোককাহিনির এই পরিক্রমণ কবে থেকে শুরু হয়েছে, তার কোন হিসেব-নিকেশ করা সম্ভব নয়। তবে আধুনিক মুদ্রণযন্ত্র আবিষ্কারের ফলে বইয়ের পাতায় ভর করে লোককথা স্থান থেকে স্থানান্তরে চলে গেছে। কিন্তু তা সত্ত্বেও লোককথার চলাচলে কোন অসুবিধে হয় না। প্রখ্যাত লোকসংস্কৃতিবিদ বেনফি উল্লেখ করেন যে, বাংলাদেশ ও ভারত উপমহাদেশের সঙ্গে মুসলমানদের ঘনিষ্ঠ যোগাযোগের ফলে ভারতীয় কাহিনি ইউরোপ, আফ্রিকা ও এশিয়ার বিভিন্ন স্থানে নীত হয়। তারপর ইতালি ও স্পেনের মাধ্যমে তা আরও বিস্তারলাভ করে। অন্যদিকে বৌদ্ধধর্মের বিপুল প্রসারের কথা মনে রাখলে দেখা যাবে, বৌদ্ধধর্মের মাধ্যমেই ভারতীয় লোককাহিনি চিনদেশে বিস্তৃত হয়। বেনফির অন্য আরেকটি মত ছিল এই যে, বৌদ্ধদের মাধ্যমে তা প্রাচ্যে বিস্তৃত হয়। এভাবে একদিকে ইসলাম ধর্মের মাধ্যমে পশ্চিমে এবং বৌদ্ধদের মাধ্যমে বাংলাদেশ-ভারতীয় লোককাহিনি তিব্বতে পৌঁছায়। আবার তিব্বত থেকে তা ছড়িয়ে পড়ে মোঙ্গলদের দেশে। মোঙ্গলরা যেহেতু দুশ বছর ইউরোপ শাসন করেছে সেহেতু বাংলাদেশ-ভারতীয় লোককাহিনি পুনর্বার ইউরোপে প্রচলিত হয়েছে। (লোককাহিনির দিক দিগন্ত --- আবদুল হাফিজ)। ত্রিপুরা জাতি বৃহত্তর বোরো জাতির অংশ। আর বোরো জাতি হল মঙ্গোলয়েড গোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্ত। সে কারণেই বেনফির উল্লিখিত সূত্র অনুসারে ত্রিপুরী লোককথার পরিব্রজনের একটা ইতিহাস আছে।
ত্রিপুরার লোককাহিনিগুলোর সঙ্গে অন্য কোনও সমান্তরাল লোককাহিনি ভারতের অন্য অঞ্চলে প্রচলিত আছে কিনা, সে বিষয়ে নিষ্ঠাবান গবেষকরা ইতিমধ্যে গবেষণা শুরু করে দিয়েছেন। ত্রিপুরার বিশিষ্ট লোকগবেষক ডঃ রণজিৎ দে আটের দশকে লিখিত তাঁর প্রবন্ধে (দক্ষিণ ত্রিপুরা ও পুরুলিয়া জেলার লোককথার সাদৃশ্য) ত্রিপুরার একটি লোককথার সঙ্গে পুরুলিয়ার একটি লোককথার সাদৃশ্য তুলে ধরেছেন। এই প্রবন্ধে রাইমা-শর্মার উৎপত্তির মিথকেন্দ্রিক অজগর সাপের যে কাহিনিটি আছে, তার সঙ্গে সমান্তরাল আলোচনায় দেখিয়েছেন যে দুটি লোককথার মধ্যেই মেয়েরা চাষের কাজে যে অংশীদার হয়েছে এবং চাষের কাজ করতে গিয়ে অজগর সাপকে স্বামীত্বে বরণ করেছে। পারিপার্শ্বিক বর্ণনার মধ্যে দুটিতে উপজাতীয় উপাদান, বাঙালি লোককাহিনির উপাদান আলাদাভাবে বিদ্যমান। ত্রিপুরার লোকসমাজে প্রচলিত আরেকটি লোককাহিনিও সেরকম প্রায় হুবহু মালভি (মধ্যপ্রদেশের এবং রাজস্থানী হিন্দি আঞ্চলিক ভাষা) লোককথা --- বর্তমান প্রাবন্ধিকের নজরে এসেছে। ত্রিপুরী এই লোককথার নাম ‘চেথুয়াং’। ‘চেথুয়াং’ অর্থাৎ ছাতিমগাছ-এর লোককথাটি এরকম --- গাইমং আর কুফুরতি দুজন ভাইবোন। একত্রে তারা জুমের কাজ করে। একদিন পাহাড়ি ছড়া পার হওয়ার সময় ভাইটি বোনের উরুর সৌন্দর্য অবলোকন করে তাকে বিয়ে করার প্রতিজ্ঞা করে বসে। ভাই গাইমং-এর মা-বাবা , প্রতিবেশী সকলেই এই ধরণের বিবাহ হয়না বলে খুব বোঝাল। কিন্তু সে কুফুরতিকে বিয়ে না করলে আত্মহত্যা করার হুমকি দিল। তখন মা-বাব বাধ্য হয়ে বোনের সঙ্গে বিয়ের ব্যবস্থা করল। একদিন তাদের ঠাকুমা ধান ঝাড়ার সময় বিয়ের কথাটা ফাঁস করে ফেলল এবং কুফুরতির কানে গেল। তখন কুফুরতি ছাতিমগাছ বা চেথুয়াং-এর কাছে গিয়ে তাকে রক্ষা করার জন্যে আমন্ত্রণ জানাল। ছাতিমগাছ তাকে তুলে নিল। ভাই গাইমুং-ও গেছে ওঠার চেষ্টা করতে লাগল। সে যত উপরে ওঠে, গাছও তত বড়ো হয়। একসময় কুফুরতি স্বর্গে চলে গেল। প্রচণ্ড ঝড়-বৃষ্টি এল। গাছটি সহ গাইমুং মাটিতে পড়ল। মালভি লোককথার গল্পটি হুবহু একই রকম, শুধুমাত্র ভাইবোনেরা রাজপুত্র ও রাজকন্যা। ‘সোনা ও রূপা’ নামের এই গল্পটির উল্লিখিত গাছটি হল এই অঞ্চলে বহুল পরিমাণে প্রাপ্য চন্দনগাছ। শ্রদ্ধেয় কুমুদ কুণ্ডু চৌধুরীর সংগৃহীত লোককথা সংকলনের প্রথম লোককাহিনি ‘বাতাস মামা’ তো আগাগোড়াই বাংলা লোককথা সুখু-দুখুর অনুরূপ। এই ‘সুখু-দুখু’ গল্পটি সম্বন্ধে ডঃ পল্লব সেনগুপ্ত তাঁর ‘লোকসংস্কৃতির সীমানা ও স্বরূপ’ গ্রন্থে যে বিস্তৃত আলোচনা করেছেন, তার উদ্ধৃতি প্রাসঙ্গিক মনে করছি।
বাংলা লোককথা ‘সুখু-দুখু’ নিয়ে জার্মান গবেষক র্যালফ ট্রোগার এবং আমেরিকান গবেষক ওয়ারেন রবার্টস পৃথকভাবে দুটি গবেষণা করে দেখিয়েছেন যে , ঐ একই টাইপের কাহিনি বিশ্বের বিভিন্ন সংস্কৃতিতে অন্তত নয়শটি রূপান্তরে ছড়িয়ে আছে। বিশ্ববিখ্যাত ‘সিন্ডারেলা’ কাহিনির তো একহাজারেরও বেশি রূপান্তর খুঁজে পাওয়া যায়। সামান্য কিছু মোটিফগত পার্থক্যের জন্যই ‘সুখু-দুখু’ এবং ‘সিন্ডারেলা’ দুটি আলাদা টাইপের বলে গণ্য করা হয়। নইলে অভ্যন্তরীণ আঙ্গিকের দিক দিয়ে বিচার করলে এই দুটি গল্পের মৌলিক প্রাণসত্তায় কোনও তফাৎ খুঁজে পাওয়া যায় না।
প্রাসঙ্গিকভাবে বহু দূর-দূরান্তের সংস্কৃতিতে একইরকম গল্প কেমন ভিন্ন ভিন্ন পোশাকে সজ্জিত হয়ে হাজির হয়ে থাকে, তার কয়েকটি নমুনা যদি মিলিয়ে দেখা হয়, তাহলে এই বক্তব্যগুলির যথার্থ যাচাই করার সুবিধেই হবে। এখানে ‘সুখু-দুখু’-র কথা উল্লেখ করা হয়েছে। ঠিক এই ছকের একটি রূপকথা পাই নাইজিরিয়াতে ‘মাতৃহীন কন্যা এক জাদুশক্তিসম্পন্ন কুকুরের (সুখু-দুখুতে এই চরিত্র এক দরিদ্র বৃদ্ধার) অনুগ্রহে ধনী এবং বিত্তবতী হয়ে ওঠায়, তার বিমাতা নিজের মেয়েকে পাঠালে, সে বেচারির কপালে জোটে যৎপরোনাস্তি বিড়ম্বনা। ‘সুখু-দুখু’-তে মাতৃহীনা দুখুর বিয়ে হয় রাজপুত্রের সঙ্গে; এখানে মাতৃহীনার বিয়ে হয় গোষ্ঠীসর্দারের সঙ্গে। বাংলা গল্পে সুখুকে গিলে ফেলে অজগর। নাইজিরিয়ার গল্পে দুর্বিনীতা এবং লোভী দ্বিতীয় মেয়েটি গোষ্ঠী থেকে নির্বাসিত হয় অর্থাৎ ভাবগত কাঠামোর দিক দিয়ে দুটি গল্পই এক; রূপগত ও কাঠামোতেও এক। পোল্যাণ্ডের লোককথায় দুই বৈমাত্রেয় বোন ‘অ্যাগনিসিয়া-ম্যারিক্সিয়া’-র গল্পও ঠিক একই ছকে গাঁথা। ( লোকসংস্কৃতির সীমানা ও স্বরূপ --- ডঃ পল্লব সেনগুপ্ত) আর ত্রিপুরী লোককাহিনিটিতে দেখি মাতৃহীনা জুমিয়া কন্যা এক অলৌকিক বৃদ্ধা ‘বাতাস মামা’-র মায়ের অনুগ্রহে তার ভাগ্যের পরিবর্তন আনে। ‘সুখু-দুখু’-র মতো ত্রিপুরী ‘বাতাস মামা’ গল্পেও বিমাতা সতীন কন্যার ভাগ্য পরিবর্তনে ঈর্ষান্বিত হয়ে নিজের মেয়েকে পাঠায়। ত্রিপুরী গল্পে মাতৃহীনা কন্যা বিত্তবতী হয়। এছাড়া ‘ঢেঁকি করে ঘোড়া প্রসব’ লোককথাটিও একটি বাংলা লোকক’ল্কজনক২ থার কিঞ্চিৎ কথান্তরিত হয়ে প্রায় অনুরূপই। বিশ্লেষণ করলে ঢেঁকির সঙ্গে এই ধার করা ঘোড়াটা আত্মসাৎ করার বামুন বুদ্ধির প্রকাশ রয়েছে গল্পটিতে। প্রতারণার জন্য বামুনের অবাস্তব যুক্তির কারণে তাকে গ্রামবাসীদের দ্বারা তিরস্কৃত হতে হয়। তেমনি ‘সোনার পাখি’ ত্রিপুরী গল্পটির শুরুতে একটা নিজস্বতা থাকলেও শেষপর্যন্ত লোককাহিনিটি দক্ষিণারঞ্জন মিত্র মজুমদারের সংকলিত একটি রূপকথার সঙ্গে বেশ মিলে যায়। পূর্বে উল্লিখিত চন্দ্রকুমারের কাহিনিতেও ব্যাঙের খোলস বদলানোর মধ্যে বাংলা লোককথা ‘বুদ্ধু-ভুতুম’-এর রাজকুমারে রূপান্তরিত হওয়ার বিষয়টি প্রচ্ছন্ন থেকে যায়। তেমনি ‘কলম্পাকন্যা’ ও ‘ছেলেরছা’ এই দুটি ত্রিপুরী লোককথাতেও রূপান্তর ব্যাপারটি আছে। এভাবে ত্রিপুরী লোককথার মধ্যে অন্যান্য লোককথার সমান্তরাল উপস্থিতি লক্ষ করা যায়। এই সামঞ্জস্যের বিষয়টি এখনও বিস্তৃত গবেষণার অপেক্ষা রাখে। যথাযথ ও আন্তরিক বিশ্লেষণ হলে ত্রিপুরার লোককাহিনিও একটি সমৃদ্ধতর পরিমণ্ডলের যোগসূত্র পেয়ে যাবে।
(শেষাংশ আগামী সংখ্যায়)
                                                                                                  
                                                                                                       HOME

এই লেখাটা শেয়ার করুন