website creator free
তৃষ্ণা বসাক        
নতুন সন্ধে

[ঈশানকোণ নতুন সংখ্যা দেখার জন্যে এখানে ক্লিক করুন]



গল্প           Home


ছাদটা যেন আলতো করে হাওয়ায় ভাসিয়ে দিয়েছে কেউ, যেমন গঙ্গায় প্রদীপ ভাসায়, অচিরেই আটকে যাবে কি উল্টে যাবে জেনেও প্রদীপ ভাসায় লোকে। অন্তিম পরিণতির আগে সে প্রদীপ যেমন অপরূপ ভাসে, এ ছাদও তেমন ভেসে আছে আসন্ন সন্ধেয়। এর পাশে অন্য ছাদগুলো কত পাকাপোক্ত, মাটির ওপর দাঁড়িয়ে আছে যে, বোঝা যায় দেখে। সেখানে শিশুর পায়ে বল, সন্ধে লেগে যাবার ভয়ে শুকনো জামাকাপড় তোলবার তাড়া, সন্ধেবাতি দেখাবার তোড়জোড়। এ ছাদটি তেমন নয়। এর ওপর দিয়ে শিবমন্দিরের চুড়ো, বিশালাক্ষী টকিহাউস সিনেমা হল, নহবতখানা দেখা যায়। সে ছাদে এক বৃদ্ধ, এক কিশোরী। বৃদ্ধটি গোলাপগাছের শুকনো পাতা, নষ্ট ডাল কেটে ফেলছে আর কিশোরী বসে আছে একটা আধভাঙা চেয়ারে, হাতে মোবাইল নিয়ে। তার চুল খোলা, আসন্ন যৌবন শরীরে ঝমঝম শব্দ তুলেছে।
ওকে চিনি। ও তো বিবির মেয়ে। ওর যখন সাত কিংবা আট মাস বয়স, বিবি মারা গেল চেন্নাইতে। স্টোভ জ্বেলে দুধ গরম করতে গেছিল মেয়ের জন্যে, তখনি নাকি গায়ে আগুন ধরে গেছিল। আমরা জানি, ওসব বাজে কথা, ওর স্বামীই লাগিয়েছিল আগুন। শ্বশুরবাড়ি যাদবপুরে। কীসব গণ্ডগোল হতে বরসুদ্ধ এসে উঠেছিল। ওদের নিচের ঘরে তখন ভাড়াটে নেই। সেই ফাঁকা ঘরগুলোতে নতুন খাট বিছানা পাতা হল। সেসময় আমার দাদারও নতুন বিয়ে হয়েছে। নতুন বৌদির সঙ্গে বিবির নিয়মিত নীল ছবি বিনিময় হতো। তখনো আমার বিয়ে হয়নি।
এই বিবিই আমাকে প্রথম ভ্রূ প্লাক করতে নিয়ে গিয়েছিল বিউটি পার্লারে। ওম্যানস ড্রিম সেসময় আমাদের ছোট শহরের একমাত্র বিউটি পার্লার। তার ভারি কাচের পাল্লা ঠেলে বিবির সঙ্গে ভেতরে ঢুকে দেখেছিলাম একজন বৃহন্নলা তার সবল রোমশ দুবাহু খুব মন দিয়ে ওয়াক্সিং করাচ্ছে। প্রথমবার ভ্রূ প্লাক করতে সাংঘাতিক লেগেছিল। তার চেয়েও শিউরে উঠেছিলাম জেল লাগানো হাতের ওপর দিয়ে গজকাপড় টানার চড়চড় শব্দে। আমি যে এরপর দীর্ঘকাল ভ্রূ প্লাক করিনি এর অন্যতম কারণ পার্লারের পাশ দিয়ে গেলেই বহুদিন পর্যন্ত ওই চড়চড় আওয়াজটা শুনতে পেতাম, দেখতে পেতাম সৌষ্ঠবহীন পুরুষালি দুই বাহুর ওপর কেমন বালি বালি রঙে থকথকে জেল লাগানো। আমার বমি পেত। আর একটা কারণ অবশ্যই কার সঙ্গে যাব? বিবি তো চলে গিয়েছিল শহর ছেড়ে। বলা ভাল, ওকে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছিল।
তখন ও বুধোর সঙ্গে প্রেম করত। ওর বাবা স্টেট ইলেকট্রিসিটি বোর্ডের ইঞ্জিনিয়ার, লাহিরীবাবু এ প্রেম মেনে নেয়নি তার মুখ্য কারণ কোন পাকাপোক্ত লোকের পক্ষেই ছেলেমেয়ের প্রেম মেনে নেওয়া পরাজয়ের সামিল। তিনটে গৌণ কারণও আছে। একঃ বুধোর ভাল নাম যতই বুদ্ধদেব হোক, ওরা মন্ডল। দুইঃ বুধো সেভেন ফাইটার্সের সেক্রেটারি, যারা সারাদিন রাসমাঠের কোণে বসে গুলতানি করে আর জনশ্রুতি চরস, গাঁজা কী না খায়। ইদানীং এদের নাকি সাট্টার পেনসিল লিখতেও দেখা গেছে। গতবছর প্রায় বস্ত্রহীন সরস্বতী করে ওরা ক্যানটার করে দিয়েছিল। আত্মসপক্ষে ওরা বলেছিল ওরা নাকি শিক্ষাজগতের নগ্নরূপ তুলে ধরতে চেয়েছে। আমাদের ছোট শহরে সেই প্রথম থিমের ঠাকুর ঢুকল। তিনঃ বুধোর বাবা পোস্টঅফিসের পিওন হয়ে অবসর নিয়েছে। আড়ালে পাড়ার ছেলেরা তাকে পিয়ানো বলে ডাকে।
যার ফলে এ বিয়ে ঠেকাতে বিবিকে অনির্দিষ্টকালের জন্যে মানিকতলার ওর মামারবাড়ি পাঠিয়ে দেওয়া হল। নিয়ে আসা হল বছর দেড়েক বাদে সেইদিন, যেদিন ওদের বাড়িতে বিয়ের ম্যারাপ বাঁধা হচ্ছে। প্রায় পুলিশ পাহারায় ওর বিয়ে দেওয়া হল। ইতিহাসের খাতিরে বলে রাখা ভাল এ ঘটনাও আমাদের শহরে প্রথম। মিলিটারি বর। দুবছর বাপেরবাড়ির একতলায় সংসার করে সেই মিলিটারি বরের সঙ্গে চেন্নাই চলে গেল বিবি। সেখানেই মেয়ে হল। ছমাস পর মামাভাত খাওয়াতে খাওয়াতে নিয়ে এসেছিল। আমাদেরও নেমতন্ন ছিল। তারপর আবার ফিরে গেল চেন্নাই। ফেরার মাসখানেকের মধ্যেই এই ঘটনা।
মা হারা মেয়ে এখানে বড় হতে থাকে। প্রথমে খাওয়ানো নিয়ে ধস্তাধস্তি, তারপর পড়াশোনা নিয়ে। চোরের মার খেত, তখন খারাপ লাগত দেখে, এখন মনে হয়, অন্যের বাচ্চা গুরুভার। কোন অলিখিত দায়িত্ব চেপে থাকে কাঁধে, সে চাপই মানুষকে প্রয়োজনের তুলনায় বেশি কঠিন আর হিংস্র করে তোলে। বিবির বাবা মা কেউই হয়তো এত খারাপ মানুষ নয়।
এখন সেসব চুকে গেছে মনে হয়। মেয়েটা নিশ্চয় স্কুল পেরিয়ে কলেজে ঢুকেছে। বহুদিন পরে দেশে ফিরেছি। আগে তাও দু-তিন বছর অন্তর আসা হত। তখন ছেলেমেয়েরাও ছোট ছিল, এদিকে বাবা মাও বেঁচে। এবার বহু বছর পরে এলাম দাদার ডাকে, বাড়িটার একটা ব্যবস্থা করতে। একাই এসেছি। ছেলে মেয়ে কলেজে ভর্তি হয়ে একজন কানসাস সিটি, আরেকজন রচেস্টারে চলে গেছে। বর পরে আসবে একই কাজে, বারাসতে ওদের পৈতৃক বাড়ির ব্যবস্থা করতে। বিকেলে ছাদে বেড়াচ্ছিলাম, মেয়েটাকে দেখে চমকে উঠলাম। এ তো সেই বিবি! হুবহু এক মুখ।
কোনদিনই বাবার সঙ্গে মেয়েটাকে দেখা করতে দেওয়া হত না। সে বাবাও শোনা যায় আবার বিয়ে করেছে।
সেই মেয়ে এখন কাকে ফোন করছে ? কার মেসেজ পড়ে হাসছে মিটিমিটি ?
বিবির মেয়ে যখন ছাদে বসে থাকে, তখন নিচের রাস্তা দিয়ে দীনভাবে চলে যায় বুধো, তার মডার্ন টেলারিং শপ খুলতে। সে মুখ তুলতেই দেখতে পায় আকাশে ভেসে থাকা ছাদ আর সে ছাদে বসে বিবি! সন্ধে পর্যন্ত বিবিও এরকম ছাদে বেড়াত। পরক্ষণেই আমার মতো ভুল ভাঙে। মেয়েটার হাতে মোবাইল দেখে সে বোঝে এ বিবি নয়। ১৮-১৯ বছর আগে কোথায় মোবাইল ? বিবি তো ১৮ বছর আগে মারা গেছে। এ বিবির মেয়ে। কার সঙ্গে কথা বলছে মেয়েটা ? সাইকেল হাঁটিয়ে নিয়ে যেতে যেতে বুধো ওকে মনে মনে বলে যায় – ‘আমি তোমার না-হওয়া বাবা। আমি তোমার মাকে কক্ষনো পুড়িয়ে মারতাম না’।
দাদুর জল দেওয়া শেষ হয়। ‘কিরে? এখনো ফোন নিয়ে বসে? পড়তে বসতে হবে না? সন্ধে হয়ে গেল তো। কলেজে ঢুকেই পাখনা গজাল?’
বিবি বেঁচে থাকলে হয়তো বলতো ‘সন্ধে হয়ে গেল, চুল খুলে রেখেছিস এখনো?’
সন্ধে হয়, বিশালাক্ষী টকি হাউসের সেকেন্ড শো ভাঙে, হল থেকে তৃপ্ত মুখে বেরিয়ে আসে মানুষ। কুড়ো ঠাকুর রাধামাধবের শীতল দিয়ে শিবমন্দিরে এসে পৌঁছয় খোঁড়াতে খোঁড়াতে।
এই সব বলা, না বলা কথার মধ্যে মোবাইল হাতে বসে থাকে মেয়েটা ঠায়, হয়তো কোন মেসেজের অপেক্ষায়।


                                                       HOME

[এই লেখাটা শেয়ার করুন]