web design software mac


নিবন্ধ            Home       
অশোকানন্দ রায়বর্ধন
ত্রিপুরার লোককাহিনিঃ মৌখিক প্রত্নকথার বিশ্বজনীন রূপ
(এক)

জনপরম্পরাক্রমে মুখে মুখে প্রচলিত বিভিন্ন মনোগ্রাহী কাহিনিকে বলা হয় লোককথা বা লোককাহিনি। তবে এই লোককথা বা লোককাহিনিগুলো হল জনশ্রুতিমূলক। আধুনিক বা পূর্ব আধুনিক যুগেরও বহু আগে এইসব কাহিনি মানুষের চিত্তজয় করে এসেছে। প্রাণীজগতে উন্নত মানুষ যে আবয়ব যন্ত্রের জন্যে, সেই বাকযন্ত্রকে মানুষ আহার্য গ্রহণ ছাড়া ভাব-বিনিময়ের মাধ্যম হিসেবেও গ্রহণ করে। পরবর্তী সময়ে এই শারীরযন্ত্রকে তার জনচিত্তজয়ের মাধ্যম হিসেবেও গ্রহণ করল। আজকের অত্যাধুনিক মিডিয়ার যে একচ্ছত্র আধিপত্য তারই কৌমরূপ সেকালের বাকযন্ত্রের ব্যবহার। সেকালে মানুষ বাচনিক ব্যবহারকে শিল্পের পর্যায়ে উন্নীত করে। সেটা হল লোকশিল্প। লোককথাও লোকশিল্পেরই অঙ্গ। অর্থাৎ এটি বাকশিল্প। অনাদি অতীতকাল থেকে মানুষ সামাজিক প্রয়োজনে, ধর্মীয় অপরিহার্যতায় এবং নিছক আনন্দ সৃষ্টির লক্ষ্যে লোককথা বা লোককাহিনি সৃষ্টি করে চলেছেন। পৃথিবীর সমস্ত আদিম জনগোষ্ঠীর জীবনচর্চায় ছিল লোককথার উপস্থিতি। অতি দীর্ঘায়ু এই সাংস্কৃতিক মাধ্যমটি আজও পৃথিবীর অজস্র ঘাত-প্রতিঘাত, অর্থনৈতিক ও সামাজিক প্রতিকূলতা ও বিবর্তনের মধ্যে বেঁচে আছে। অপরিসীম তার জীবনশক্তি। এই জনশ্রুতিমূলক গল্পসমূহ পৃথিবীর যে প্রান্তেরই হোক না কেন, তার অন্তর্বয়নের মধ্যে এক বা একাধিক নিজস্ব ঐতিহ্য প্রায় সর্বত্র বজায় থাকে। একেই লোকবিজ্ঞানী স্টিথ টমসন ‘মটিফ’ সংজ্ঞায় আখ্যায়িত করেছেন। স্টিথ টমসন ‘মটিফ’-এর সংজ্ঞা দিতে গিয়ে বলেছেন, “A motif is the smallest element in a tale having a power to persist in tradition. In order to have this power it must have something unusual and striking about it.” [Stith Thompson, The folktale. Page-415]. অর্থাৎ ‘মটিফ’ হল গল্পের ক্ষুদ্রতম এমন একটি অংশ যা পরম্পরাক্রমে বেঁচে থাকার ক্ষমতা রাখে। তার এই শক্তির মধ্যে কিছু অসাধারণ এবং আকর্ষণীয় উপাদান থাকে। লক্ষ্য করা গেছে যে এই ‘মটিফ’-এর ক্ষেত্রে পৃথিবীর দূরতম দুটি প্রান্তের মধ্যেও অদ্ভুত মিল দেখা যায়। তারই কারণে লোককথাকে সর্বজনীন স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে। বলা হয়েছে লোককথা বিশ্বজনীন। দেশবিদেশের লোককথা বিশ্বলোককথারই অঙ্গ। শুধু খুঁজে নেওয়া, তাদের মধ্যে পারম্পারিক ঐতিহ্য কী পরিমান।
পৃথিবীর লোককথার বিশাল ও বিস্ময়কর ভাণ্ডার রয়েছে। মৌখিক ঐতিহ্যে বেঁচে থাকা এই বিপুল পরিমান লোককথার খুবই সামান্য অংশ সংগৃহীত হয়েছে। এখনও বহু লোকসমাজ পাদপ্রদীপের আলোয় আসেনি, যাদের লোককথা আজও প্রকাশ হয়নি। কবে থেকে লোককথার প্রচলন হয়েছে তার উৎসমূলে একেবারে আক্ষরিক অনুসন্ধান করা সম্ভব না হলেও তার অতি প্রাচীনতা সম্বন্ধে একেবারে নিশ্চিন্ত হওয়া যায়। তারই নিদর্শন হিসাবে আমরা আজও গাঁয়ের বটতলায়, পারিবারিক বৈঠকী আসরে, ঠাকুমা-দিদিমার বুকের উষ্ণতার মধ্যে, আষাঢ়-শ্রাবণের ঝরঝর বর্ষার দিনের কর্মহীন অলস জীবন-যাপনের কালে, লৌকিক ব্রত পালনকালীন সময়ে ব্রতকথার রূপকে লোককাহিনি চলে আসতে দেখি। এ চিত্র আমাদের বাঙালি জীবনে শুধুমাত্র নয়, লোকসংস্কৃতির প্রাজ্ঞ গবেষক স্টিথ টমসনের মতে, “In villages of central Africa, in outrigger boats in the Pacific, in Australian bush, and within the shadow of Hawaian volcanoes, tales of the present and of the mysterious past, of animals and Gods and heroes, and of men and women like themselves, holds their listeners in their spell or enrich the conversion of daily life”. [Stith Thompson, The folktale]. এই উদ্ধৃতিটি থেকে স্পষ্ট হয় যে, পৃথিবীর সমস্ত লোকসমাজের মধ্যে লোককাহিনি প্রচলিত ছিল। সভ্যতার অগ্রগতির সাথে সাথে কিছু কিছু প্রাচীন সভ্য জাতির লোককথার লিখিত রূপও প্রকাশ পেয়েছে। আমাদের দেশে বেদ ও পুরাণ কাহিনিসমূহ, বিষ্ণুশর্মার সংকলনে, গ্রীসের মহাকাব্য ইলিয়াড-ওডিশিতে, রাশিয়ার প্রিন্স ইগোরের কাহিনিমালায়, ঈশপের লোককথা সংগ্রহে, আরব্য-পারস্য কাহিনিতে এসব লোককথা কালক্রমে গ্রথিত হয়েছে। পরবর্তী বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন লোক গবেষক ও উৎসাহী ব্যক্তিবর্গ লোককাহিনি সংগ্রহে মনোযোগ দেন, যার ফলে বিশাল লোককথার সংগৃহীত ভাণ্ডার তৈরি হয়। তবুও পৃথিবীর বিভিন্ন অংশের বিভিন্ন ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠীসকলের মধ্যে গিয়ে সংগ্রহের কাজটি এখনও রয়েছে অপূর্ণ --- অনেকের সংস্পর্শে এখনও আসা সম্ভবপর হয়ে ওঠেনি।
ভারতবর্ষের উত্তর-পূর্বাঞ্চলে অবস্থিত ক্ষুদ্র রাজ্য ত্রিপুরা। অতি প্রাচীন এই পার্বত্য জনভূমিটি প্রায় নির্জনেই তার বুকে অফুরন্ত লোকজ সম্পদ নিয়ে অবস্থান করছে। তার খবর বহির্ভারতের তথা বিশ্বের কাছে এখনও প্রায় অনালোকিতই রয়ে গেছে। এই রাজ্যে ত্রিপুরী, জমাতিয়ে, নোয়াতিয়া, রিয়াং, গারো, চাকমা, উচই, মগ, ভিল, ওঁরাও, হালাম, লুসাই, মুন্ডা, সাঁওতাল প্রভৃতি
প্রায় ১৯টি আদিবাসী জনগোষ্ঠীর বসবাস। এছাড়া রয়েছে সমৃদ্ধ বাঙালি জনগোষ্ঠী। অরণ্যঘেরা এই রাজ্যটির জনগোষ্ঠীর নিজস্ব সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য রয়েছে। রয়েছে শ্রুতি সাহিত্যও। লোক-সাংস্কৃতিক বিভিন্ন উপাদানে সমৃদ্ধ এখানকার বিভিন্ন উপজাতীয়দের সম্বন্ধে বিস্তৃত আলোচনা বা গবেষণা এখনও অপেক্ষমান। কৌম জনজীবনের অনেক বৈশিষ্ট্যই আজও ত্রিপুরা রাজ্যের অনেক উপজাতি সমাজের মধ্যে বিদ্যমান। কিন্তু অত্যাধুনিক জীবনযাত্রার ভোগবাদী প্রভাব ইতিমধ্যে এই জীবনধারার মধ্যে থাবা বসিয়ে ফেলেছে। যদি এখনও যা কিছু কিছু সূত্র রয়েছে, সেগুলো সংগ্রহ না করা হয়, তাহলে অচিরেই সেগুলো কালগর্ভে হারিয়ে যে যাবে সে বিষয়ে নিশ্চিত।
ত্রিপুরা যে লোককথার বিশাল ভাণ্ডার তার একটি বিশিষ্ট উদাহরণ হল যে, এই রাজ্যের নামকরণের পেছনে রয়েছে কিংবদন্তী এবং পুরাণাশ্রিত কাহিনি। লোককাহিনির শ্রেনীকরণের মধ্যে লোকপুরাণ বলে একটি বিষয় আছে, তার মধ্যে কিংবদন্তীকে রাখা হয়েছে। তাছাড়া বিভিন্ন প্রাচীন ধর্মাশ্রিত গ্রন্থসমূহকে পুরাণ নামে আখ্যায়িত করা হয়। কোনও জাতির লোক-সাংস্কৃতিক উপাদানে পুরাণ কাহিনি প্রচিষ্ট হয়ে যায় সেই অঞ্চলের প্রচলিত ধর্মচেতনার প্রভাবে। তেমনই এদেশে আর্যরা আসার পর অনেক স্থানীয় প্রাচীন ও ব্রাত্য দেবদেবী আর্যীকরণের ফলে লৌকিক দেবদেবীতে রূপান্তরিত হয়ে গেছে। মিশ্রণ-সংমিশ্রণের এই পর্যায়ে তেমনি অনেক লোককাহিনি অর্থাৎ কিংবদন্তীও তার নিজস্বতা হারিয়ে আর্যান্তরিত হয়ে গেছে। এই আলোকেই ত্রিপুরা নামের প্রেক্ষাপটে জড়িত কিংবদন্তী ও পুরাণকাহিনি দুটি বিশ্লেষণ করা যেতে পারে।
‘ত্রিপুরা’ নামের ব্যুৎপত্তিগত ব্যাখ্যা প্রসঙ্গে কৈলাসচন্দ্র সিংহ এই রাজ্যের নামকরণের একটি সূত্র উদ্ভাবন করেছেন। এখানকার অধিবাসী ‘বরক’ জাতিদের শব্দ ‘তুইপ্রা’ থেকে বিশ্লেষণ করে ‘তুই’ অর্থে জল এবং ‘প্রা’ অর্থে সন্নিহিত ভূখণ্ড বোঝায়। এতে প্রাচীন ত্রিপুরার ভূখণ্ডের ভৌগোলিক সীমা নির্দেশ করে। এককালে ত্রিপুরা রাজ্যের সীমা বঙ্গোপসাগর তীরবর্তী পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল বলে কথিত আছে। ত্রিপুরার বিশিষ্ট লোকগবেষক ডঃ রনজিৎ দে এ প্রসঙ্গে বলেন, ‘মনে হয় চট্টগাম, নোয়াখালি প্রভৃতি অঞ্চলসমূহ সমুদ্র গর্ভ থেকে উঠে আসার পূর্বে সমুদ্রের বিস্তার এই পর্বতময় ত্রিপুরার পাদদেশ পর্যন্ত ছিল।‘ (রাজন্যশাসিত ত্রিপুরা ও চট্টগাম--- ডঃ রণজিৎ দে, পৃ ৪)। যারই উত্তরশ্রুতি হল মেঘনা-তিতাস অধ্যুষিত অববাহিকা জিলা ত্রিপুরা ও বঙ্গোপসাগর থেকে উত্থিত নবপললভূমি বাইশটি পরগণা নিয়ে গঠিত চাকলা-রোশনাবাদের ত্রিপুরা রাজ্যের অঙ্গীভূত হওয়া। এ প্রসঙ্গে ত্রিপুরার রাজমালায় উল্লিখিত ত্রিপুরা সীমান্ত সম্বন্ধীয় বহু আলোচিত পংক্তিগুলো স্মরণ করছি ---

‘ত্রিবেগ স্থলেতে রাজা নগর করিল
কপিল নদীর তীরে রাজ্যপাট ভৈল
উত্তরে তৈউঙ্গ নদী দক্ষিণে আচরঙ্গ
পূর্বে মেখলি সীমা পশ্চিমে কাচরঙ্গ’

কাজেই একটা ভূখণ্ড ও জাতিগোষ্ঠীর পরিচয়ের সঙ্গে যে কিংবদন্তীটি জড়িত আছে লোককাহিনির উপাদান হিসেবে, তাও কম মূল্যবান নয়। স্থাননাম থেকে ঐ স্থানে বসবাসকারী জনগোষ্ঠীর নাম হওয়ার উদাহরণও প্রাচীন জনগোষ্ঠীর মধ্যে দেখা যায়। আলোচিত কিংবদন্তী ‘ত্রিপুরা’ বা ‘তিপ্রা’ বা ‘তুইপ্রা’ জাতির প্রাচীন ভৌগোলিক অবস্থানকে নির্দেশ করছে।
ত্রিপুরা নামের উৎস হিসেবে লিখিত যে সাহিত্যিক উৎসটি পাওয়া যায়, তা মহাভারতীয় প্রভাবে প্রভাবান্বিত। ত্রিপুরা অতি প্রাচীন রাজ্য। মহাভারতেও এই রাজ্য কিরাতভূমি হিসেবে চিহ্নিত আছে। ত্রিপুরার রাজা ধর্মমাণিক্যের আদেশে ত্রিপুর রাজবংশের আখ্যান রাজমালা লিখিত হয়। শ্রুতি কাহিনিকে আশ্রয় করে এই রাজমালা রচিত হয়। মহাভারতের চন্দ্রবংশীয় রাজা যযাতি ছিলেন একজন প্রবল পরাক্রান্ত রাজা। তাঁরই তৃতীয় পুত্র দ্রুহ্যু হলেন ত্রিপুর বংশের আদিপুরুষ। মহাভারতীয় পুরাকাহিনিতে দেখা যায়, শুক্রাচার্যের অভিশাপে মহারাজা যযাতি অসময়ে জরাগ্রস্ত হয়ে পড়েন। মহারাজা শুক্রাচার্যের কাছে বারংবার অনুরোধ জানালেন এমন কঠিনতম শাস্তি না দিতে। কিন্তু যেহেতু নিয়তি। অভিশাপ ফিরিয়ে নেওয়া যাবে না। সেই কারণে শুক্রাচার্য একটি উপায় বের করলেন। মহারাজা যযাতি যদি তাঁর এই জরাভার কাউকে অর্পণ করতে পারেন, তাহলে তিনি শাপমুক্ত হবেন। সেই অনুযায়ী তিনি তাঁর পুত্রদের এই দুঃসহ জরাভার গ্রহণের জন্য আহ্বান জানালেন। তাঁর পাঁচপুত্রের মধ্যে একমাত্র কনিষ্ঠ পুত্র পুরু এই জরাভার গ্রহণে সম্মত হয়। অন্য যে চারপুত্র তাঁর জরাভার গ্রহণ করতে রাজি হননি, তিনি তাঁদের শাস্তি দিয়ে দূর-দূরান্ত প্রদেশসমূহের দায়িত্বভার অর্পণ করে পক্ষান্তরে নির্বাসন দণ্ডই দিলেন। সেইমত দ্রুহ্যু ‘কিরাতদেশ’-এর অধিপতি হন এবং ‘ত্রিবেগ’ নামক স্থানে রাজ্য স্থাপন করেন। দ্রুহ্যুর পুত্র ত্রিপুর কিরাতভূমির রাজা হন। তিনি এত অত্যাচারী ছিলেন যে প্রজাগণ বিদ্রোহী হয়ে তাঁকে হত্যা করে। আবার একটি কিংবদন্তীতে দেখা যায় যে ত্রিপুর দ্রুহ্যুর পুত্র নন। জনৈক দৈত্য বা অসুরের পুত্র ত্রিপুর। তাঁর অত্যাচারে জর্জরিত প্রজাদের আকুল প্রার্থনায় মহাদেব ত্রিপুরকে বধ করেন। কথিত আছে, এই দ্রুহ্যুর পুত্র বা দৈত্যের পুত্র অহঙ্কারী ত্রিপুরের নাম অনুসারে ত্রিপুরা নামের প্রচলন হয়। লোককথায় স্থাননাম প্রসঙ্গ অন্যতম বিষয়। এ প্রসঙ্গে সোমদেবের কথাসরিৎসাগরের পাটলিপুত্র নগরের নামকরণ সম্বন্ধে একটি লোককথা স্মর্তব্য।
লক্ষ করার বিষয় যে, একটি জাতির আলোচ্য প্রাচীনতম উৎসটির সঙ্গে লোককাহিনি যেরকম একাধিকভাবে বিজড়িত রয়েছে, তাতে এটাও উপলব্ধি করা যায় যে, এই জাতিগোষ্ঠীর লোককাহিনিরও একটি বিশাল ভাণ্ডার লুকিয়ে আছে। লোককাহিনি শুধুমাত্র মনোরঞ্জক কাহিনি নয়, এই কাহিনির মধ্য দিয়ে একটা জাতিগোষ্ঠীর প্রাচীন ইতিহাসের উপাদানও অনেকাংশে প্রচ্ছন্ন থেকে যায়। সেইরকমই লোকশ্রুতি বা কল্পকাহিনিনির্ভর রাজন্য ইতিহাস হলেও ত্রিপুরা জাতির প্রাচীনকালে স্থান থেকে স্থানান্তরে বিচরণের তথ্যও নিহিত রয়ে গেছে। কপিল নদীর তীরে ত্রিবেগ নামক স্থান (বর্তমানে আসামের নওগাঁও জেলা), বরবক্র নদীর তীরে খলংমা নামক স্থান (বর্তমান কাছাড়), মনু নদীর তীরে শাম্বলনগর (বর্তমানে উত্তর ত্রিপুরা জেলা), রাঙ্গামাটি (বর্তমান পার্বত্য চট্টগ্রাম) ইত্যাদি স্থানে বিভিন্ন সময়ে বসতি ও রাজ্যপাট স্থাপনের ইতিহাসকে অবশ্যই স্মরণ রাখতে হয়।
বিভিন্ন স্থানে বা বিভিন্ন ভাষায় লোককাহিনিকে বিভিন্ন নামে আখ্যায়িত করা হয়ে থাকে। ইংরেজিতে যেমন ‘ফোকটেল’ তেমনি ভারতবর্ষের বিভিন্ন ভাষায়ও ‘টেল’ বা কথা শব্দটি যে কোনোভাবেই ব্যবহৃত হতে দেখা যায়। যেমনঃ
বাংলায় --- রূপকথা, উপকথা, দাঁতকথা, রাতকথা, পরনকথা, কিচ্ছা, শোলোক, হরস্তাপ (প্রস্তাব > পরস্তাব), গল্প ইত্যাদি। অসমে --- সাধুকথা। ওড়িয়ায় --- কথা। সাঁওতালি ভাষায় --- কথা (কাথা)। হিন্দিভাষী অঞ্চলে --- কহানী, কিস্‌সা, কহাবৎ ইত্যাদি।
তেমনি ত্রিপুরা রাজ্যেও স্থানীয় ককবরকভাষীরা (এঁরা বৃহত্তর বোড়ো জাতির অংশ) একে বলে থাকেন ‘কেরেং কথমা’। ত্রিপুরা রাজ্যের ককবরক ভাষার নিরলস গবেষক ত্রিপুরার লোককথার সংকলন ‘কেরেং কথমা’-র প্রথম সংস্করণের ভূমিকাতে এর ব্যুৎপত্তিগত ব্যাখ্যা করেছেন নিম্নরূপভাবে।
‘ত্রিপুরী রূপকথাকে ককবরক ভাষায় বলে ‘কেরেং কথমা’। ‘কেরেং’ শব্দটির ব্যুৎপত্তি সম্ভবত এরূপঃ কক+এরেঙ ( সমীভবনের ফলে কেরেং), ককবরকে ‘কক’ অর্থ ‘কথা’ এবং ‘এরেঙ’ অর্থ ‘অলীক’। তাহলে ‘কেরেং’-এর অর্থ দাঁড়ায় কথা-অলীক (যেমন- কগ-বরক। বিশেষণ সবসময় বিশেষ্যের পরে বসে) --- বাংলায় অলীক কথা। ‘কেরেং’-এর পরে যে ‘কথমা’ শব্দটি আছে, তার ব্যুৎপত্তি সম্ভবত কক+বথমা। এবং কক-বথমা-র ‘কথমা’-য় রূপান্তর হতে পারে এভাবে--- কক-বথমা > কক-থমা > কথমা। ‘বথমা’-র কগবরক অর্থ হল মূল থেকে বিস্তৃত শিকড়-বাকড় অথবা কোন কিছুর সন্ধিস্থল। এভাবে ‘কেরেং কথমা’-র পুরো অর্থ দাঁড়ায় ‘অলীক কথার সন্ধিস্থল বা উৎসমুখ’। তহলে এখানেও অন্যান্য অঞ্চলের মতো ত্রিপুরার আরণ্যক জনজীবনেও যে গল্প বলার এবং গল্প শোনার স্বাভাবিক প্রবণতা ছিল সে কথাটি তার নামকরণের মধ্যেই স্পষ্ট হয়ে যায়। পূবেই উল্লেখ করেছি, গল্প বলা বা শোনার প্রবণতা মানূষের প্রাচীন। সেদিক দিয়ে ত্রিপুরার লোককথাও অতি প্রাচীনকাল থেকেই টংঘরের মাচার ওপর , জুমখেতের পাশে, গৃহপালিত পশুচারণভূমিতে, কখনও বা গভীর অন্ধকার বনাঞ্চলের ততোধিক অন্ধকার রাত্রিবেলায় বন্য পশুর হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য রাতজাগাকালীন কিংবা শীতের রাতে জ্বালানো ধুনির পাশে বসে শোনা হত এইসব লোকমুখে বর্ণিত ‘কথা’ বা ‘কেরেং’। লোকচারণিক আশরাফ সিদ্দিকী তাঁর ‘লোকসংস্কৃতি’ প্রথম খণ্ডে প্রসঙ্গক্রমে উল্লেখ করেছেন, ‘ঢাকা সাভারের ভারতচন্দ্র রায় নামক এক কথাব্যবসায়ী এই সেদিনও ত্রিপুরার রাজসভায় রাজা, রাজপুত্র ও রাজপরিবারের সকলকে নির্দিষ্ট সময়ে গল্প শোনাতেন।‘
ত্রিপুরার লোককথা সংগ্রহের ইতিহাস তেমন প্রাচীন নয়। একসময় তা মুখে মুখেই প্রচলিত ছিল। অধুনা বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে এগুলো সংগ্রহের একটা প্রচেষ্টা চলছে। তার সংখ্যা এতটাই নগণ্য যে সেগুলো নিয়ে বিশ্লেষণাত্মক আলোচনাও তেমন বেশি হয়নি। যার ফলে বক্ষ্যমান প্রবন্ধেও কিছু কিছু প্রচলিত লোককথাসমূহ এবং কুমুদ কুন্ডু চৌধুরীর সংগৃহীত ত্রিপুরার লোককথার সংকলন প্রাগ্‌উক্ত ‘কেরেঙ কথমা’ গ্রন্থের বিভিন্ন লোককাহিনিকে বিশ্লেষণাত্মক আলোচনার অন্তর্ভুক্ত করার প্রয়াস পাচ্ছি। এক্ষেত্রে যে বিষয়গুলির উপর দৃষ্টি নিবদ্ধ রাখা হবে, তার মধ্যেঃ
প্রথমত, লোককাহিনিগুলোতে নিজস্বতার প্রমাণস্বরূপ কোনও লোক উপাদান পাওয়া যায় কিনা সে বিষয়ে লক্ষ রাখা হবে।
দ্বিতীয়ত, ত্রিপুরী লোককথা সমূহের সঙ্গে সমান্তরালভাবে অন্য কোন লোককথার সাদৃশ্য পাওয়া যাচ্ছে কিনা বা সেইসব সাদৃশ্যের পেছনে প্রচ্ছন্ন কারণসমূহ অনুসন্ধানের প্রচেষ্টা থাকবে।
তৃতীয়ত, কাহিনিসমূহের বিশ্বজনীনতা সন্ধানের জন্য কাহিনিগুলোতে মটিফ প্রযুক্ত রয়েছে কিনা তা বিশ্লেষণ করে দেখা হবে।
সবশেষে, লোককথা সমূহে সমাজচিত্রের , শ্রেণীচেতনার ও প্রাচীন রীতিনীতির কোনও সন্ধান পাওয়া যায় কিনা সে বিষয়ে আলোকপাত করা হবে।
উপরের যে সমস্ত বিষয়ের আলোচনার অবতারণা করা হয়েছে, বস্তুতপক্ষে স্বল্পপরিসরে প্রবন্ধে তা সম্ভবপর নয়। সে কারণেই সহায়ক সংগ্রহ গ্রন্থ হিসেবে যে গ্রন্থটিকে আকর করার অঙ্গ স্বীকার করা হয়েছে, তার সবগুলি হয়ত আলোচনা করা সম্ভব হবেনা। তবে যথাসম্ভব বিভিন্ন কৌণিক দিক থেকে এইসব লোককাহিনিগুলোর উপর আলোকসম্পাত করা হবে।
বিশ্বের বিভিন্ন ভাষার লোককাহিনিতে লোকপুরাণ বা ‘মিথ’ বলে একটা বিষয় আছে। কেউ কেউ বলে থাকেন ‘মিথ’ হল লোককাহিনির আদিরূপ। পৃথিবীর আদি পর্যায়ের অধিবাসীরা যখন বিভিন্ন রকম প্রাকৃতিক বিষয়সমূহের উৎস সম্বন্ধে অজ্ঞ ছিল এবং সেই বিষয়গুলোকে স্বাভাবিকভাবে ব্যাখ্যা করতে অপারগ হত, তখন তারা এর পেছনে কোনও অলৌকিক শক্তির উপস্থিতিকে উপলব্ধি করত। এবং এই শক্তিসমূহকে কেন্দ্র করে অজ্ঞাত বিষয়টির উৎস সম্বন্ধে এক ধরণের কাহিনি গড়ে তুলত। লোকবিজ্ঞানের ভাষায় এই সমস্ত কাহিনিকেই বলা হয় ‘মিথ’ বা লোকপুরাণ। একে বাংলায় কোন কোন লোকবিজ্ঞানী ‘সৃষ্টিকথা’ বলেও নামকরণ করেছেন। তাঁদের হিসাবমতো চৌদ্দটি এ ধরণের ‘সৃষ্টিকথা’ বা ‘লোকপুরাণ’ বা ‘মিথ’-এর উপস্থিতি তাঁরা লক্ষ করেছেন। এগুলো হল ---
১) সৃষ্টিরহস্য‌ ২) মহাপ্লাবন, ৩) আত্মা, ৪) দেবতার জন্ম, ৫) মানুষের উদ্ভব, ৬) দেব-দানবের দ্বন্দ্ব, ৭) চন্দ্র-সূর্য-তারা-গ্রহ, ৮) দিন-রাত্রি, ৯) বিভিন্ন প্রাণীর বৈশিষ্ট্য, ১০) স্বর্গ-নরক-পাপ-পুণ্য, ১১) জন্ম-মৃত্যু, ১২) আচার-সংস্কার, ১৩) অগ্নি, ১৪) বিভিন্ন শিল্পবস্তুর অবস্থান।
                                                              (পরবর্তী অংশ আগামী সংখ্যায়)


                                                  HOME

[এই লেখাটা শেয়ার করুন]